ঢাকা, বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১ আপডেট : ৪ মিনিট আগে
শিরোনাম

‘নিউ নর্মালে’ সুন্দর এক গ্রামে

  ফিচার ডেস্ক

প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২০, ১৫:৪০  
আপডেট :
 ০৬ অক্টোবর ২০২০, ১৫:৫৭

‘নিউ নর্মালে’ সুন্দর এক গ্রামে

হালস্টাট, অস্ট্রিয়ার ছোট্ট একটি গ্রাম। বিশ্বের সুন্দর গ্রামগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি। করোনাকালে সেই গ্রাম ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সত্যি অন্যরকম নানা কারণে।

প্রতি বছর অন্তত ১০ লাখ মানুষ ছোট্ট এই গ্রামটি ভ্রমণে যান। কারণ গ্রামটি সত্যিই ছবির মতো সুন্দর। আল্পসের কোলে ষোড়শ শতকের পুরোনো সব কাঠের বাড়ি আর লেক সব মিলিয়ে অপূর্ব এই গ্রামের জনসংখ্যা ৯শ'রও কম।

করোনায় সবাই যখন বাড়ির ভেতরে থাকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তখন কেন আমরা ঘুরতে গেলাম এবং তা-ও এমন একটা জায়গা বেছে নিলাম? আসলে মাতৃত্বকালীন ছুটির মধ্যে করোনা এসে গেল, শুরু হলো হোম অফিস। এক বছরের সন্তান, অফিস, পড়ালেখা-বাড়ি সব সামলাতে আমরা দু'জন এতটাই বিধ্বস্ত ছিলাম যে, মাথা কাজ করছিল না। কোথাও বেরিয়ে আসাটা খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল। তাই বরের পিএইচডি থিসিস জমা দেয়ার পর অফিস থেকে ছুটি নিয়ে নিলাম। এরপর ঘুরতে যাওয়ার বিষয়ে নানা আলোচনা। কোন যাত্রায় করোনার বেশি ঝুঁকি। সন্তানের জন্য সুবিধা বিমানযাত্রা, কারণ, কম সময় লাগে। কিন্তু এক সহকর্মী কিছুদিন আগে ভিয়েনা ভ্রমণ করে এসে জানালেন বিমানে মাঝের আসন ফাঁকা রাখার কথা বলা হলেও আসলে ফাঁকা রাখা হয় না। তাই নিরাপত্তার কথা ভাবলে গাড়ি অথবা ট্রেন। যেহেতু আমরা দুজনেই গাড়ি চালাতে পারি না, তাই ট্রেন ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিলাম।

ভ্রমণের গন্তব্য বাছার এবং কোথায় থাকা হবে সে দায়িত্ব বরাবরই আমার। তো আমি সাম্প্রতিক বিভিন্ন ভ্রমণ ব্লগ থেকে যা জানলাম, তা হলো যেসব জায়গায় সাধারণত বেশি মানুষ ঘুরতে যায়, করোনায় সেসব জায়গাতেই লোক সমাগম তুলনামূলক কম। এসব ব্লগে ইউরোপের যে কয়টি জায়গার উল্লেখ আছে তার মধ্যে হালস্টাট একটি। ঠিক হলো হালস্টাট যাওয়া হবে ট্রেনে। ট্রিপ অ্যাডভাইজারে জানতে চাইলাম জার্মানি থেকে অস্ট্রিয়া যেতে হলে চিকিৎসকের কোনো চিঠি লাগবে কিনা বা করোনা পরীক্ষার প্রয়োজন আছে কিনা। জানতে পারলাম তেমন কিছুর দরকার নেই।

ডয়চে বান-এর অনলাইন ওয়েবসাইট থেকে টিকেট কিনলাম। বুক করলাম ফ্যামিলি অ্যান্ড চিলড্রেন কম্পার্টমেন্ট, অর্থাৎ, যেখানে আমরা ছাড়া আর কেউ যাতে না থাকে।

এয়ারবিএনবিতে একটি অ্যাপার্টমেন্ট বুক করা হলো গ্রামের প্রাণকেন্দ্র থেকে মাত্র ৯০০ মিটার দূরে। যাওয়ার আগে বেশ কিছু জীবানুনাশক স্প্রে, দস্তানা, লোশন, টিস্যু পেপার কেনা হলো। যাত্রার জন্য বেছে নিলাম সোম থেকে শুক্রবার৷। কারণ, সপ্তাহান্তে ভিড় বেশি হতে পারে, সেটা এড়াতে।

যথা সময়ে ট্রেন স্টেশন পৌঁছে মাস্ক পরে নিলাম। কারণ, স্টেশনের ভেতরে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। ট্রেনে ওঠার সময়ও মাস্ক পরেই থাকতে হবে। নির্দিষ্ট কম্পার্টমেন্টে উঠে দেখলাম ছোট্ট ছিমছাম একটা ঘরের মতো। বাচ্চাদের জন্য ছবি আঁকা আছে, পাশেই টয়লেট, যেখানে ন্যাপকিন বদলানোর ব্যবস্থা আছে। উঠেই আমরা জীবানুনাশক স্প্রে দিয়ে পুরো কক্ষের সব কিছু মুছে ফেললাম। যেহেতু ওই রুমে আর কেউ নেই, তাই মাস্ক পরে থাকার শাস্তি থেকে মুক্তি পেলাম। তবে রুমের বাইরে গেলেই মাস্ক পরা বাধ্যতামুলক। একটা বগি পরেই ট্রেনের রেস্তোরাঁ, সেখানে যেতে যেতে দেখলাম অন্য বগিতে প্রত্যেক যাত্রী মাস্ক পরে রয়েছেন, তবে একই পরিবার বা দলের না হলে আসন ছেড়ে রেখে বসেছেন। মাস্ক পরাটা যে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে তা দেখেই বোঝা যায়। ট্রেনের প্রতিটা স্টপে বার বার ঘোষণা হচ্ছিল মাস্ক পরে থাকার জন্য এবং সব স্বাস্থ্যবিধি যথাসম্ভব মানার জন্য। রেস্তোরাঁতেও এসব নির্দেশনা লেখা ছিল।

একটানা ৭ ঘণ্টার যাত্রা শেষে আমরা জালসবুর্গ স্টেশনে পৌঁছালাম। সেখানে দেখলাম সবাই আরো বেশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে। অর্থাৎ, বন শহরে আমরা রাস্তাঘাটে মাস্ক পরি না। দোকানপাটে গেলে পরি। এখানে রাস্তাঘাটেও সবাই মাস্ক পরে আছেন। আর চেষ্টা করছেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার।

জালসবুর্গ থেকে হালস্টাট যেতে তিনটি পথ আছে, একটি হলো বাস, যা দুইবার পরিবর্তন করতে হবে, অন্যটি ট্রেন সেটি একবার পরিবর্তনের পর ফেরি করে গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে আর তৃতীয়টি গাড়ি। আমরা আগে থেকে অনলাইনে চালকসহ একটি গাড়ি ভাড়া করেছিলাম। স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন চেকপ্রজাতন্ত্রের চালক মাইকেল। চেক প্রজাতন্ত্রের বলে এই সার্ভিসে ট্যাক্সির তুলনায় ভাড়া কম। গাড়ির সামনের ও পেছনের আসনের মাঝে প্লেক্সিগ্লাসের আবরণ, চালক মাস্ক পরলেন, আমরাও পরে নিলাম। এরপর টানা দেড় ঘণ্টার যাত্রা। টিপ টিপ বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ উঁকি দিচ্ছিলো আল্পসের চূড়া।

অপূর্ব ছোট ছোট সবুজে ঘেরা গ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম হালস্টাটে। তখন সেখানেও বৃষ্টি। সন্ধ্যা নামার অপেক্ষা। এআরবিএনবির মাধ্যমে যে অ্যাপার্টমেন্টটি বুক করা হয়েছিল ড্রাইভার আমাদের ঠিক সেখানে পৌঁছে দিলো। হোস্ট ভদ্রমহিলা ওই বাড়িতেই থাকেন উপরতলায়। আর আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে নীচতলায়। উনি উপরতলা থেকে নেমে এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন মুখে মাস্ক ছাড়াই, তবে হাত মেলালেন না সঙ্গত কারণে। তিনি আমাদের চাবিসহ সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে উপরে চলে গেলেন, বললেন কোনো দরকারে উপরে ডাক দিলেই হবে। আমরা ড্রাইভারকে বিদায় জানিয়ে ঘরে ঢুকলাম। জানালা খুলতেই দেখা দিলো বিশাল পাহাড় আর পাহাড়ের গায়ে গায়ে মেঘ জড়িয়ে আছে, কী অপূর্ব সেই দৃশ্য। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ছোট্ট পাহাড়ি নদী। তার কলকল শব্দ এখনো যেন কানে বাজে।

আমরা যাত্রার সব পোশাক ছেড়ে সেগুলো আলাদা একটা ব্যাগে রেখে প্রথমে বাচ্চাকে গরম পানিতে গা মুছিয়ে একে একে গোসল করে নিলাম। তারপর খেয়ে দেয়ে ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিলাম বিছানায়, এরপর আর কিছু মনে নেই।

পরদিন সকালে উঠে জানালা দিয়ে আবারো পাহাড়ের দেখা মিলল। এবার তার অন্য রূপ। আমাদের সকালের খাবার ব্যবস্থা ছিল ওই অ্যাপার্টমেন্টেই। তাই নাস্তা করে বেরিয়ে পড়লাম গ্রাম দেখতে। প্রথমে একটি ম্যাপ নিয়ে বুঝে নিলাম কোথায় কী আছে। তারপর হাঁটা শুরু করলাম। সময় তখন সকাল সাড়ে ৯টা। খুব সুন্দর রোদ উঠেছে, তেমন ঠাণ্ডা নেই। অথচ রাস্তাঘাটে মানুষজন নেই বললেই চলে।

এই গ্রামটি বিখ্যাত সাত হাজার বছরের পুরোনো লবণ খনির জন্য। সেই খনিতে উঠতে হয় কেবল কারে করে, যেটি আমাদের এয়ারবিএনবি’র একেবারেই পাশে। যেহেতু আমাদের পাঁচ দিনের ঘোরার পরিকল্পনা। তাই লবণ খনিটি দেখার জন্য শেষের দিনটি ঠিক করলাম। আর আজ এলোমেলোভাবে ঘোরা হবে ঠিক হলো। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম একটা পার্কে যেখানে শিশুদের খেলার জায়গা। আমাদের বাচ্চা সেখানে গিয়ে আনন্দে আত্মহারা। পাশেই হালস্টাট লেক। পুরো গ্রামটি সেখান থেকে দেখা যায়। সেখানে গিয়ে দেখি, একটি মাত্র শিশু তার দাদা-দাদির সাথে খেলতে এসেছে। শিশুটি যে রাইডেই চড়ছে তার দাদা স্যানিটাইজার দিয়ে তা আগে মুছে দিচ্ছেন। আমরাও তাই করলাম।

এরপর রওনা দিলাম গ্রামের কেন্দ্রে, যেটিকে বলে মার্কেট, অর্থাৎ বাজারের কেন্দ্র। উদ্দেশ্য দুপুরের খাওয়া। দেখলাম, সব রেস্তোরাঁয় নির্দেশনা দেয়া- আগে বাইরে দূরত্ব মেনে দাঁড়াতে হবে। এরপর ওয়েটার এসে একজন করে নিয়ে যাবে। কারণ, যে অতিথি খেয়ে গেছেন, সেই টেবিল তারা জীবাণুমুক্ত করে পরিষ্কার করে তারপর অতিথিদের বসতে দিচ্ছিলেন। রেস্তোরাঁতেও যথারীতি খাওয়ার আগ পর্যন্ত মাস্ক পরে থাকতে হলো, ওয়েটাররা সবাই মাস্ক পরে ছিলেন। লেকের মাছ দিয়ে তৃপ্তির সাথে খাওয়া শেষ করলাম।

এরপর রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সেখানকার বিশেষ ক্রিমরোল খাওয়ার জন্য লম্বা লাইন ধরতে হলো। ক্রিমরোল খেয়ে দিনের শেষ ফেরিতে চেপে বসলাম, উদ্দেশ্য লেক ভ্রমণ। ছোট্ট জাহাজের টিকেট কাউন্টারে লেখা ছিল, অল্প জায়গা বলে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখা না গেলে পুরোটা সময় সবাইকে মাস্ক পরে থাকতে হবে। কিন্তু দিনের শেষ ফেরি বলে লোকজন খুব একটা ছিল না। তাই মাস্কবিহীন আমরা আরামেই একঘণ্টা নৌবিহার করলাম।

এরপর রাতের জন্য খাবার বেঁধে নিয়ে চলে গেলাম অ্যাপার্টমেন্টে৷ এই গ্রামটি এত ছোট যে, কেউ যদি পাহাড়ে না ঘুরে কেবল গ্রামটা হেঁটে ঘুরে দেখতে চায় তাহলে একদিনই যথেষ্ট৷ এ কারণে এখানে অতিথিরা রাত কাটান কম। অন্য শহর থেকে এখানে এসে ঘুরে আবার ফিরে যান। এ কারণে সন্ধ্যা ৬টার পর দোকানপাট, এমনকি রেস্তোরাঁও বন্ধ হয়ে যায়।

তবে করোনার কারণে মানুষজন একেবারেই কম। এখানকার লোকজন বলছিলেন, করোনার আগে প্রতিদিন মানুষের ভিড়ে হাঁটাই কষ্টকর ছিল, গাড়ি পার্ক করার জায়গা পাওয়া ছিল দুষ্কর, বেশিরভাগই চীনা পর্যটক। অথচ এবার কেবল পূর্ব ইউরোপের মানুষজনই বেশি দেখলাম এখানে। হালস্টাটের কাছেই চেকপ্রজাতন্ত্রের সীমান্ত।

পরদিন পুরোদিন বৃষ্টি হলো। বিকেলের দিকে বৃষ্টি ধরে এলে হাঁটতে হাঁটতে শহরের কেন্দ্রে গিয়ে দেখি পর্যটক না আসায় দোকানপাট আগেই বন্ধ করে দিয়েছে।

তৃতীয় দিন সকালে উঠেই ভালো আবহাওয়া দেখে ঠিক হলো লবণ খনি দেখতে যাবো। সকাল সাড়ে নয়টা থেকে কেবল কার চালু হয়, আমরা পৌনে দশটায় পৌঁছে দেখি আর মাত্র দুইজন আছে সেখানে। একটা কেবল কারে দুটো ভাগ। একটাতে আমরা তিনজন এবং অন্যপাশে আরো দুইজন মাস্ক পরে রওনা দিলাম।

বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নেয়া হালস্টাটের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ এই লবণ খনি, যেটি স্থলভাগ থেকে ৩৬০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। উপর থেকে ৬০ বর্গ কিলোমিটারের ছোট হালস্টাটকে আরো অপূর্ব লাগছিল। সেখানে রেস্তোরাঁতেও সবাই সামাজিক দূরত্ব মেনে বসছিলেন। তবে স্কাইওয়াকের যে জায়গাটি থেকে সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখা যায় ছবি তোলার জন্য অনেকেই ভুলে গিয়েছিলেন মাস্ক ও সামাজিক দূরত্বের কথা। উপরের এই স্বর্গীয় সৌন্দর্য আসলে হয়ত সবাইকে ভুলিয়ে দিয়েছিল করোনার কথা।

এদিন বিকেলে ষোড়শ শতাব্দীর কাঠের বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হয়েছিল আমরাও যেন সেই সময়ে আটকে গেছি। রাস্তায় শুধু আমরাই। সামনে স্থানীয় এক বৃদ্ধা হেসে আমাদের বাচ্চাকে একগোছা ফুল ধরিয়ে দিলো। মনে হলো যেন বললো আবারও পৃথিবীটা স্বাভাবিক হবে, ভয় পেয়ো না। সূত্র: ডয়চে ভেলে

বাংলাদেশ জার্নাল/এনকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত