একনজরে জামায়াতে ইসলামীর উত্থান-পতন
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২৪, ১৭:২০ আপডেট : ০১ আগস্ট ২০২৪, ১৮:২৪
জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির ও তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুযায়ী নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) বিকেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ হলো।
১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট লাহোরের ইসলামিয়া পার্কে সামাজিক-রাজনৈতিক ইসলামি আন্দোলনের অংশ হিসেবে ‘জামায়াতে ইসলামী হিন্দ’ নামে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী। পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী’র একটি শাখা হিসেবে দলটি পূর্ব পাকিস্তানে গঠিত হয়।
বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর পূর্বনাম ছিল ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’। পরে ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনে দলটির সংশোধিত নাম জমা দেয়া হয়, তখন থেকে দলটির নাম হয় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এর ছাত্রসংগঠনের হলো ইসলামী ছাত্রশিবির। তবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে এটির নাম ছিল ‘ইসলামী ছাত্র সংঘ।’
ভারতের মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করেছিল জামায়াত। এমনকি দলটি ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় দল মুসলিম লীগকে সমর্থন করেনি। স্বাধীনতা ও ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর মওদুদী ভারত থেকে পাকিস্তান চলে যান।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার এবং পাকিস্তান বিভক্তির বিরোধিতা করেছিল জামায়াত। প্রায়শই জামায়াত মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার পেছনে ভারতীয় আধিপত্যের আশঙ্কা এবং ইসলামী আন্দোলনের স্বার্থকে সামনে আনে। দলটি মুক্তিযুদ্ধেকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে এ দেশের নিরস্ত্র মানুষ, বুদ্ধিজীবী এবং সংখ্যালঘু হিন্দুদের হত্যায় সহযোগিতা করেছিল।
জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে রাজাকার, আলবদর, আল শামস প্রভৃতি বাহিনী গড়ে তোলে। এরা পুরো মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে কাজ করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে এই দলের সদস্যরা হত্যা, ধর্ষন, লুটপাট, সংখ্যালঘু নির্যাতন, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা, ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যকাণ্ডে জড়িত থাকাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রমাণিত হয়েছে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর নতুন সরকার জামায়াতকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং দলের নেতারা পাকিস্তানে নির্বাসনে চলে যান। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর এবং কয়েকটি সামরিক অভ্যুত্থানের পর ১৯৭৭ সালে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে জামায়াতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়া হয় এবং দলটির নেতাকর্মীরা ফিরে আসার অনুমতি পান। ১৯৭৯ সালের মে মাসে তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা আব্বাস আলী খানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৮০-এর দশকে জামায়াত গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধারের জন্য বহুদলীয় জোটে যোগদান করে। এ সময় দলটি আওয়ামী লীগ ও সমসাময়িক বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে পরবর্তীতে দলটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আন্দোলন করে। পরবর্তীতে ২০০১ সালে নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে বিএনপির সঙ্গে মিলিত হয়ে আরও অন্য দুটি দলসহ চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে চারদলীয় ঐক্যজোট জয়লাভ করলে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে জামায়াতের দুজন সদস্য মন্ত্রী নির্বাচিত হন।
২০০৮ সালের পর থেকে নেতৃবৃন্দ আটক পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের রায়ে দণ্ডিত হওয়ায় দলটি কিছুটা দূর্বল হয়ে যায়। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলটি ৩০০টি আসনের মধ্যে মাত্র ৫টি আসন লাভ করে।
২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি কয়েকটি ইসলামি সংগঠনের ২৫ জন সদস্য জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করলে বাংলাদেশের হাইকোর্ট একটি রুল জারি করে। জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ এবং বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন সচিবকে ৬ সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলে আদালতের বেঞ্চ। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট রুলের রায় ঘোষণা করে। এতে সংগঠনের নিবন্ধন অবৈধ এবং সংগঠনটিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।
২০১০ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে; ২০১২ সালের মধ্যে দুজন বিএনপি নেতা ও জামায়াতের সাবেক ও বর্তমান সদস্যসহ ৮ জন নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের মামলা দায়ের করা হয়। ২০১৩ সালের জুলাই পর্যন্ত জামায়াতের সাবেক সদস্যসহ মোট চার জনকে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা ও একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও সাবেক আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছর কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
যুদ্ধাপরাধের বিচারে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতারা ফাঁসিতে ঝুলেছেন, এবং বহু নেতা কারাগারে ও আত্মগোপনে আছেন। এ কারণে দলের তৎপরতা গত এক দশক ধরে অনেকটাই নেতিয়ে পড়েছে। ঢাকার মগবাজারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বহু বছর ধরে তালাবদ্ধ। এর মধ্যে দলেও ভাঙন ধরেছে। বহু বছরের বিতর্কের পর বিএনপির জোটেও আর নেই জামায়াতে ইসলামী।
সবশেষ গত বছর আপিল বিভাগে নিবন্ধন বাতিলের রায় বহাল থাকায় ভোটের রাজনীতিতেও প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে জামায়াত। এ অবস্থায় সরকারের নির্বাহী আদেশে দলটির রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয়েছে।
নিবন্ধন বাতিল হওয়ার পরও এতদিন দলটি ঝটিকা মিছিল বা জমায়েত হয়ে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় থাকার সুযোগ পাচ্ছিল জামায়াত। নির্বাহী আদেশে দলটি নিষিদ্ধ ঘোষণা হওয়ায় সেসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেয়া যাবে। এমনকি জামায়াতকে কোনোভাবে সহযোগিতা বা অর্থায়ন করার পথও আইনিভাবে বন্ধ হয়ে যাবে।
চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার ঘটনায় জামায়াত ও এর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের জড়িত থাকার অভিযোগ করে আসছিলেন সরকারের মন্ত্রীরা। এ প্রেক্ষিতে গত সোমবার (২৬ জুলাই) আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় সভায় জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে একমত হন ওই জোটের শীর্ষ নেতারা। আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সেই বৈঠক হয়। জোটের বৈঠকে সিদ্ধান্তের পর সরকারের নির্বাহী আদেশে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ জার্নাল/কেএইচ