ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮ পৌষ ১৪৩১ আপডেট : ১৮ মিনিট আগে
শিরোনাম

আদালতে কয়েকটি মাইলফলক রায়ের মধ্যদিয়ে নতুন প্রত্যাশায় শেষ হচ্ছে- ২০২৪

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩:০৯

আদালতে কয়েকটি মাইলফলক রায়ের মধ্যদিয়ে নতুন প্রত্যাশায় শেষ হচ্ছে- ২০২৪
ফাইল ছবি

হাইকোর্টের দেয়া কোটা পুনর্বহাল রায়কে কেন্দ্র করে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতন ও উল্লেখযোগ্য বেশকিছু মাইলফলক রায়ে নতুন প্রত্যাশায় শেষ হচ্ছে ২০২৪ সাল।

কোটা সংক্রান্ত মামলা:

কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলনের সূচনা ২০১৮ সালে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার চেয়ে আনা একটি রিট খারিজ করে দিয়েছিল হাইকোর্ট। আদেশ বলা হয়েছিল, এটি সরকারের পলিসি ম্যাটার। তাই রিটটি সামারালি রিজেক্ট করা হয়। পরে ওই বছর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে চাকরিতে কোটা তুলে দিয়েছিল সরকার। পরবর্তীতে চলতি বছর ৫ জুন হাইকোর্টের এক রায়ে কোটা পুনর্বহাল হলে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে শুরু হয় নতুন আন্দোলন। এরই ধারাবাহিকতায় হাজারো শহিদের রক্তের বিনিময়ে ৫ আগস্ট আন্দোলনে বিজয় অর্জন করে ছাত্র-জনতা। ওইদিন পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা।

ছাত্র-জনতার আন্দোলন নির্মূলে পরিচালিত গণহত্যা-মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার:

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন নির্মূলে পরিচালিত হত্যা-গণহত্যার বিচার হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করা হয়েছে।

গত ১৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হাইকোর্টের বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার। ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্যানেলের অপর দুই সদস্য হলেন- হাইকোর্টের বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মহিতুল হক এনাম চৌধুরী। গত ৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। আরো বেশ ক'জন আইনজীবীকে প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১০ জন কর্মকর্তার সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়েছে। যেখানে তদন্ত সংস্থার কোঅর্ডিনেটর পদে মো. মাজহারুল হককে (অ্যাডিশনাল ডিআইজি, অবসরপ্রাপ্ত) এবং কো-কোঅর্ডিনেটর পদে মুহাম্মদ শহিদুল্যাহ চৌধুরীকে (পুলিশ সুপার, অবসরপ্রাপ্ত) নিয়োগ দেওয়া হয়।

ছাত্র-জনতার আন্দোলন নির্মূলে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গত ১৭ অক্টোবর গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ইতোমধ্যে পতিত আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী উপদেষ্টা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাসহ বেশ কিছু কর্মকর্তাকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে তারিখ ধার্য রয়েছে।

নতুন প্রধান বিচারপতি:

দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ গত ১১ আগষ্ট শপথ গ্রহণ করেন। এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের হাজার হাজার শিক্ষার্থী সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও করার পরে গত ১০ আগস্ট সাবেক প্রধান বিচাপতি ওবায়দুল হাসান ও আপিল বিভাগের আরো পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগ করেন। প্রধান বিচারপতি ছাড়া অন্য পাঁচ বিচারপতি হলেন- এম ইনায়েতুর রহিম, মো. আবু জাফর সিদ্দিকী, জাহাঙ্গীর হোসেন, মো. শাহিনুর ইসলাম ও কাশেফা হোসেন।

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের রোডম্যাপ ঘোষণা:

স্বাধীন ও জবাবদিহিতামূলক বিচার বিভাগ গড়ার প্রত্যয়ে গত ২১ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ইনার কোর্ট ইয়ার্ডে দেশের বিচারকদের উপস্থিতিতে রোডম্যাপ ঘোষণা করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৭ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট হতে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠন সংক্রান্ত প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। ঘোষিত রোডম্যাপের ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যে দেশের উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নে খসড়া করা হয়। গত ২৮ ডিসেম্বর বিষয়টি নিয়ে মতবিনিময় আয়োজন করে আইন মন্ত্রণালয়। সুপ্রিম কোর্টের বিচার সেবার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে প্রধান বিচারপতি গত ১৮ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে দিক-নির্দেশনামূলক বক্তৃতা দেন। সুপ্রিম কোর্টের সেবা সহজিকরণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে ১২ দফা নির্দেশনা প্রদান করেন। সুপ্রিম কোর্টে আগত কোনো বিচারপ্রার্থী বা সেবাগ্রহীতা সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির কোনো শাখায় সেবা গ্রহণে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হলে বা সেবা গ্রহণ সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো অসুবিধার মুখোমুখি হলে উক্ত সেবাগ্রহীতাকে সহায়তা করার নিমিত্ত একটি হেল্পলাইন নাম্বার (+৮৮ ০১৩১৬১৫৪২১৬ ) চালু করা হয়েছে।

বেগম খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত:

বহুল আলোচিত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের সাজার বিরুদ্ধে গত ১১ নভেম্বর বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) মঞ্জুর করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে খালেদা জিয়াকে দেওয়া ১০ বছরের সাজা স্থগিত করেছেন সর্বোচ্চ আদালত। খালেদা জিয়ার আপিল শুনানি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সাজা স্থগিত থাকবে।

আইনি লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত বেগম খালেদা জিয়ার:

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফ করেছেন রাষ্ট্রপতি। তবে রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমার পরেও মামলা দুটি আইনগতভাবে লড়ার কথা জানিয়ে বিএনপির আইনজীবী বলেন, বেগম খালেদা জিয়া আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। রাষ্ট্রপতি তার সাজা মওকুফ করেছেন। সেখানে ক্ষমার কথা আছে। বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমার প্রতি বিশ্বাসী নন। তিনি অপরাধ করেননি। তিনি ক্ষমাও চাননি। তাই এটা আইনগতভাবে মোকাবিলা করতে তিনি আইনজীবীদের বলেছেন। সে অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে বিগত আমলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রণোদিত মামলায় তিনি আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

তারেক রহমানের সাজা স্থগিত:

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাত বছরের সাজা স্থগিত করে গত ১০ ডিসেম্বর আদেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। অর্থ পাচারের অভিযোগে আনা এ মামলায় বিচারকি আদালতেও খালাস পেয়েছিলেন তারেক রহমান। তবে বিগত সরকারের আনা আপিলে তাকে সাজা দেয় হাইকোর্ট। এখন এ সাজা স্থগিত করলো আপিল বিভাগ।

কুইক রেন্টাল দায়মুক্তির বিধান অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট রায়:

'কুইক রেন্টাল’ আইন নামে পরিচিতি বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনের দায়মুক্তি সংক্রান্ত বিধান অবৈধ ঘোষণা করে গত ১৪ নভেম্বর রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। এই আইনের অধীনে করা কাজ নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না এবং চুক্তি করার বিষয়ে মন্ত্রীর একক সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রশ্নে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় ঘোষণা করা হয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনটি ২০১০ সালের ১২ অক্টোবর প্রণয়ন করা হয়। আইনের ‘পরিকল্পনা বা প্রস্তাবের প্রচার’-সংক্রান্ত ৬(২) ধারা ও ‘আদালত ইত্যাদির এখতিয়ার রহিত করা’-সংক্রান্ত ৯ ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিটটি করা হয়।

আদালতের এখতিয়ার রদ করতে পারে এমন কোনো আইন হতে পারে না। এটা চ্যালেঞ্জ করা হয়।

একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত সব আসামি হাইকোর্টে খালাস:

একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ দণ্ডিত সব আসামি খালাস পেলেন। এ মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে বিচারিক আদালতের রায় অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে গত ১ ডিসেম্বর এ রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।

এ মামলায় ২০১৮ সালে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ বিচারক শাহেদ নূরউদ্দিন রায় ঘোষণা করেন। মামলায় বাবরসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, বিএনপির নেতা হারিছ চৌধুরী, কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইনসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন মেয়াদে ১১ জনকে দণ্ড দেয় বিচারিক আদালত। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় মতিঝিল থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি মামলা হয়।

নিবন্ধন ফিরে পেতে জামায়াতের আপিল শুনানি শুরু:

রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বাতিল হওয়া নিবন্ধন ফিরে পেতে গত ৩ ডিসেম্বর আপিল শুনানি শুরু হয়। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে চার বিচারপতির বেঞ্চে শুনানি হচ্ছে। গত ২২ অক্টোবর রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বাতিল হওয়া নিবন্ধন ফিরে পেতে খারিজ হওয়া আপিল পুনরুজ্জীবিত করে আদেশ দেয় আপিল বিভাগ। এর ফলে নিবন্ধন ও দলীয় প্রতীক দাঁড়িপাল্লা ফিরে পেতে জামায়াতের আইনি লড়াই করার পথ খুলে যায়। এক রিট আবেদন নিষ্পত্তি করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট। এরপর ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। পরবর্তীতে হাইকোর্টে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে জামায়াতে ইসলামী। তবে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল শুনানিতে জামায়াতের মূল আইনজীবী উপস্থিত না থাকায় গত নভেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ ‘ডিসমিস ফর ডিফল্ট’ বলে আপিল খারিজের আদেশ দেন। ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল থাকে। আপিল বিভাগে পেন্ডিং মামলাটি পূর্ণাঙ্গ শুনানি হয়ে নিস্পত্তি হয় নাই। 'ডিসমিসড ফর ডিফল্ড' হয়। জামায়াত মামলাটি পুনরুজ্জীবনের আবেদন করে।

১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় হাইকোর্ট রায়:

চট্রগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনায় করা মামলায় মৃত্যুদণ্ড থেকে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ কয়েক আসামিকে খালাস দিয়ে ১৮ ডিসেম্বর রায় ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামির সাজা কমিয়ে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। আর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি পরেশ বড়ুয়াকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। দশ ট্রাক অস্ত্র আটক সংক্রান্ত দু’টি মামলার মধ্যে চোরাচালান মামলায় (বিশেষ ক্ষমতা আইনে) সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়াসহ ১৪ আসামিকে ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় দেন চট্টগ্রামের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১।

বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে সংক্রান্ত রিভিউ নিষ্পত্তি:

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের বিধান সংক্রান্ত সংবিধানের বহুল আলোচিত ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ‘রিভিউ’ আবেদন গত ২০ অক্টোবর পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

সেই সাথে ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ থেকে বাতিল ২ থেকে ৮ উপ-অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল (রিস্টোর) করে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ রায় দেন।

এই রায়ের ফলে কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে অসমর্থতা ও পেশাগত অসদাচরণের কোনো অভিযোগ উঠলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া যাবে বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা।

এ রায়ের ফলে, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় বহাল রইলো এবং বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছ থেকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ফিরল।

রায়ের আলোকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্ট রায়:

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল অবৈধ ঘোষণা করে ১৭ ডিসেম্বর রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে সংবিধানে গণভোটের বিধান ফিরিয়ে এনেছেন উচ্চ আদালত। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে হয়েছিল। যে কারণে এটি সংবিধানের মৌলিক ভিত্তি হয়ে গেছে।

পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করা হয়েছিল। সংবিধানের মূল কাঠামো হচ্ছে গণতন্ত্র। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই পারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে। সংবিধানের সৌন্দর্য হচ্ছে জনগণের ক্ষমতায়ন, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস।

আদালতে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সাজা ও খালাস:

বাংলাদেশে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে করা একটি মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ও নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকার তিন নম্বর শ্রম আদালতের বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা এ রায় ঘোষণা করেন। পরে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে খালাস পান সকল আসামি। বিতর্কিত মামলা ও রায় নিয়ে দেশ বিদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়।

যেসব আলোচিত মামলার বিচার পুরান ঢাকার নিম্ন আদালতে:

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়েরকৃত মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন অনেক রাজনৈতিক নেতা। এর পাশাপাশি শেষ হয়েছে বেশ কিছু আলোচিত মামলার বিচারও।

সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলার রায়:

৩৪ বছর আগে সগিরা মোর্শেদ রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় দুষ্কৃতিকারীদের গুলিতে নিহত হন। সেই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বিচার শেষ হয়েছে এ বছর। গত ১৩ মার্চ রায়ে আনাস মাহমুদ ওরফে রেজওয়ান ও মারুফ রেজাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩ এর বিচারক। রায়ে ডা. হাসান আলী চৌধুরী, সায়েদাতুল মাহমুদ ওরফে শাহীন এবং মন্টু মণ্ডল খালাস পান।

চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার বিচার:

২৬ বছর আগে সংঘটিত নায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার বিচার চলতি বছরের ৯ মে শেষ হয়েছে। নৃশংস এ খুনের মামলায় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই ওরফে আব্দুল আজিজ, ট্রাম্পস ক্লাবের মালিক আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম ও আদনান সিদ্দিকীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। দণ্ডিত এই তিন আসামি পলাতক থাকায় আদালত তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাসহ সাজা পরোয়ানা জারি করেছেন। অন্য ৬ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তারা খালাস পেয়েছেন। তারা হলেন- সেলিম খান, হারুন অর রশীদ ওরফে লেদার লিটন ওরফে বস লিটন, আদনান সিদ্দিকী, আশিষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী, তারিক সাঈদ মামুন ও ফারুক আব্বাসী।

কথিত গণপিটুনিতে রেনু হত্যার বিচার:

রেনু হত্যা মামলা পাঁচ বছর আগে ২১ জুলাই রাজধানীর বাড্ডায় সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করার খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনির শিকার হয়ে নিহত হন তাসলিমা বেগম রেনু। ৯ অক্টোবর এ মামলার রায়ে সবজি বিক্রেতা ইব্রাহিম ওরফে হৃদয় মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ড, ময়না বেগম, আবুল কালাম আজাদ, কামাল হোসেন ও আসাদুল ইসলামকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ঢাকার ষষ্ঠ অতিরিক্তি মহানগর দায়রা জজ। তবে ৮ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পান।

হলমার্ক কেলেঙ্কারির এক মামলার বিচার:

হলমার্ক কেলেঙ্কারির মামলা হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ দুর্নীতির ১১ মামলার মধ্যে এক মামলার রায় হয়েছে। রায়ে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ ও তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামসহ ৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। ১৯ মার্চ ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১ এর বিচারক মো. আবুল কাশেমের আদালত এ রায় দেন। এছাড়া সোনালী ব্যাংকের সাবেক শীর্ষ সাত কর্মকর্তাকে ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী তিথি সরকারকে সাজা:

জবি শিক্ষার্থীর সাজা হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে কটূক্তির দায়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী তিথি সরকারকে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল ১৩ মে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন।

সাবিনা ইয়াসমিনকে খুনের মামলার বিচার:

ঢাকা জেলার আশুলিয়ায় আশা এনজিও'র কিস্তির টাকা আদায় করতে গিয়ে সিনিয়র লোন অফিসার মোছা. সাবিনা ইয়াসমিনকে খুনের মামলায় ২৫ নভেম্বর রায় দেন আদালত। ঢাকার প্রথম অতরিক্তি জেলা ও দায়রা জজ মোসা. রাজিয়া খাতুন ও মো. আশরাফুল ইসলাম মানিককে মৃত্যুদণ্ড দেন।

ব্যবসায়ী জামিল হোসেনকে হত্যার বিচার:

ব্যবসায়ী জামিল হোসেনকে (৩২) গলা কেটে ও কুপিয়ে হত্যার দায়ে ১৭ অক্টোবর স্ত্রী মৌসুমি, ভায়রা জুয়েল রানা ওরফে তানভীর ও ভাড়াটিয়া খুনি শফিকুল আলম ওরফে কসাই শফিককে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন ঢাকার ৬ষ্ঠ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আলীকে হত্যার বিচার:

ঢাকা জেলার কেরাণীগঞ্জের পশ্চিম রোহিতপুর এলাকায় বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর আলীকে হত্যার দায়ে ২৪ এপ্রিল ভাতিজা ঠান্ডুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন ঢাকার ৮ম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংক্রান্ত এক রিট মামলার রায়কে কেন্দ্র করে ছাত্ররা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু করে। বিগত সাড়ে পনেরো বছর রাষ্ট্রযন্ত্রকে কুক্ষিগত করে ক্ষমতায় আকড়ে থেকে ফ্যাসিষ্ট হয়ে ওঠা শেখ হাসিনার সরকার যৌক্তিক আন্দোলন নির্মূলে গণহত্যাসহ ভয়ানক দমন-পীড়নের পথ বেছে নেয়। আবু সাঈদ, মুগ্ধ ওয়াসিমসহ হাজারো শহিদদের রক্ত ও ২৩ সহস্রাধিক আহত মানুষের ত্যাগ এবং কোটি মানুষের বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। এরপর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শপথ নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

এদিকে নানা ঘটনাপ্রবাহ ২০২৪ বাংলাদেশকে বিশ্বের বর্ষসেরা দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। নবীন প্রজন্ম এক দানবের মুঠো থেকে দেশকে ছিনিয়ে এনেছে। ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ লড়াই ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে সমকালীন বিশ্বের বিরল এক গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশ স্বৈরাচার ও আধিপত্যবাদী আগ্রাসন থেকে মুক্ত হয়েছে। জনতার এই অভ্যুত্থান গোটা বিশ্বকে অবাক করেছে। ১৯৭১ সালের পরে ২০২৪ বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় একটি ঘটনাবহুল বছর।

বাসস।

বাংলাদেশ জার্নাল/এমপি

  • সর্বশেষ
  • পঠিত