ঢাকা, সোমবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ১৩ কার্তিক ১৪৩১ আপডেট : ৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

অগ্রাধিকার: রাষ্ট্রপতির অপসারণ নাকি নির্বাচন কমিশনের সংস্কার? 

  আবু জুবায়ের

প্রকাশ : ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৩৪

অগ্রাধিকার: রাষ্ট্রপতির অপসারণ নাকি নির্বাচন কমিশনের সংস্কার? 
ছবি: সংগৃহীত

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। বহুল প্রত্যাশিত গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতা থেকে মহাবিপ্লবের মাধ্যমে পদচ্যুত করা এবং দেশ থেকে পলায়নের ঘটনা দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে এক নতুন দিগন্তে পৌছেঁ দিয়েছে।

ছাত্র-জনতা ও তরুণ সমাজের এই গণজাগরণ দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি নতুন আশার সঞ্চার করেছে। তবে এই অভ্যুত্থানের পরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্রপতির অপসারণ জরুরি নাকি একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের গঠন ও সংস্কার র্বতমান পরিস্থিতিতে অধিক গুরুত্বর্পূণ?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাস, রাষ্ট্রপতির ভূমিকা এবং নির্বাচন কমিশনের উপর জনমতের প্রভাবের বিশ্লেষণ করতে হবে। পাশাপাশি র্বতমানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ম্যান্ডেট, ছাত্র সমাজের আন্দোলনের লক্ষ্য এবং আগামী নির্বাচনের গুরুত্ব বিচার করাও জরুরি।

২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে নানা সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়। বিচার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিরোধী দলগুলোর ওপর নিপীড়ন এবং প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যবহার জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। বিশেষ করে ছাত্র ও তরুণ সমাজের মধ্যে বেকারত্ব, শিক্ষাক্ষেত্রে অনিয়ম, বৈষম্য এবং নিপীড়ন বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা বড় একটি আন্দোলনে শামিল হয়।

ছাত্র সমাজের আন্দোলনের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থান সংঘটতি হয় যাকে বলে শেখ হাসিনার শাসনকালের সমাপ্তিই ঘটায়নি বরং বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য একটি নতুন পথ দেখিয়েছে। ছাত্র জনতা ও তরুণ সমাজের এই আন্দোলন সরকারের প্রতি জনগণের আস্থার সংকটকে প্রকাশ্যে এনে দেয় এবং দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের দাবিকে নতুন করে সামনে আনে।

বিগত বছরগুলোতে শেখ হাসিনার সরকারের রাষ্ট্রপতি দের ভূমিকা নানা কারণেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সাধারণত একটি প্রতীকী অবস্থানে থাকলেও দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থান এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনার পদত্যাগপত্র তাঁর কাছে না থাকার কথা জানানোর পর জনগণের মধ্যে সন্দেহ দানা বেঁধেছে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা তাঁর পদত্যাগ দাবি করেছে। অন্যদিকে অনেক রাজনৈতিক দল বলছে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি যাতে না তৈরি হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং হটকারই কিছুকরা যাবে না।

রাষ্ট্রপতির অপসারণ প্রক্রিয়া সংবিধান অনুযায়ী সংসদীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন করা যায় যে খানে দুই-তৃতীয়াংশ ভোট প্রয়োজন হয়। তবে র্বতমান পরিস্থিতিতে সংসদীয় প্রক্রিয়া অব্যাহত না থাকায় এবং সেই অনুযায়ী অপসারণ প্রক্রিয়া চালানোর বাস্তবতা এই সংসদবিহীন বাংলাদেশে সম্ভব নয়।

এছাড়া র্বতমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ম্যান্ডেট হচ্ছে স্বল্পমেয়াদে একটি সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা। এই মুর্হূতে রাষ্ট্রপতির অপসারণ প্রক্রিয়া শুরু করলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের মূল দায়িত্ব থেকে বিচ্যুত হতে পারে এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উপর প্রভাব রাখতে পারে। রাষ্ট্রপতির অপসারণের চেয়ে অধিক জরুরি বিষয় হচ্ছে দেশের সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন, র্কাযর্কযর, এবং গ্রহণযোগ্য করার পথে এগিয়ে যাওয়া।

অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশন একটি গণতান্ত্রিক কাঠামোর অন্যতম গুরুত্বর্পূণ স্তম্ভ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ খুলে দিতে পারে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। অতীতে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালন এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগ ব্যাপকভাবে উঠে এসেছে যা জনগণের মধ্যে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থার সংকট সৃষ্টি করেছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হলে এই প্রতিষ্ঠানকে সর্ম্পূণ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত এবং স্বচ্ছ করতে হবে। এর জন্য কমিশনের গঠনে নতুন কমিশনারদের যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া অত্যন্ত গুরুত্বর্পূণ। এ কমিশন শক্তিশালী এবং র্কাযর্কযর হলে জনগণের ভোটের অধিকার সঠিকভাবে প্রতি ফলিত হবে এবং গণতন্ত্রের প্রতি তাদের আস্থা ফিরে আসবে।

রাষ্ট্রপতির অপসারণ বনাম নির্বাচন কমিশন সংস্কার: কোনটি অধিক গুরুত্বর্পূণ?

গণতান্ত্রিক পুর্নগঠনের জন্য রাষ্ট্রপতির অপসারণের তুলনায় নির্বাচন কমিশনের সংস্কার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা অধিক গুরুত্বর্পূণ। কারণ একাধারে এটি একটি স্বল্পমেয়াদি এবং তাত্ক্ষণিক ফলাফল প্রদান করতে পারে। এ মুর্হূতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে দেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং একটি নিরপেক্ষ, অবাধ, সকলের কাছে গ্রহণযোগ্যয় নির্বাচন আয়োজন করা। এ দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও র্কাযর্কযারি তা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যা রাষ্ট্রপতির পদ পরির্বতনের চেয়ে গণতান্ত্রিক কাঠামোকে অধিক মজবুত করবে।

নির্বাচন কমিশনের সংস্কার মাধ্যমে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য ন্যায়সংগত ও দায়িত্বশীল পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব। এটি গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার গুরুত্বর্পূণ পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করবে। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতির অপসারণ যদি প্রয়োজনীয় হয়ও এটি গণতান্ত্রিক কাঠামোকে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করবে না এবং এ মুর্হূতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বর্পূণ।

ভবিষ্যৎ করণীয়: গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কার্যকর দিকনির্দেশনা

গণঅভ্যুত্থানের পরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে গণতান্ত্রিক কাঠামোর পুর্নগঠন ও জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার নিশ্চিত করা। এই পথে কয়ে কটি গুরুত্বর্পূণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন, যার মধ্যে নির্বাচন কমিশন সংস্কার অন্যতম প্রধান:

● নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের গঠন: নতুন কমিশনারদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত এবং স্বচ্ছনীতি নিশ্চিত করা।

● প্রশাসনিক সংস্কার: প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে সংস্কার করা এবং সাধারণ জনগণের সেবায় নিয়োজিত করা।

● বিচার ব্যবস্থা স্বাধীনতা নিশ্চিত করা: বিচার ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।

● গণমাধ্যমের স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা: সেন্সরশিপ মুক্ত করে গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়া।

● সুশাসন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা: প্রশাসন ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে দেশের জনগণের আস্থা র্অজন।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ নতুন গণতান্ত্রিক কাঠামোর স্বপ্ন দেখছে। তবে এ কাঠামোকে স্থায়ী ও শক্তি শালী করতে হলে র্কাযর্কযর এবং স্বাধীন নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা সর্বাধিক গুরুত্বর্পূণ। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার এই যাত্রায় রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে জটলিতা সৃষ্টরি চেয়ে নির্বাচন কমিশন সংস্কার অনেক বেশি তাৎর্পয এবং দেশের জনগণের র্স্বাথে অধিক র্কাযর্কযর।

সামগ্রিকভাবে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত শক্তি শালী নির্বাচন কমিশনের গঠন এবং দেশের সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যা দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি ফলন ঘটাবে এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করবে।

আবু জুবায়ের, কবি, গবেষক

বাংলাদেশ জার্নাল/ওএফ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত