বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি ভিত্তিক সম্পর্ক
আবু জুবায়ের
প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২৪, ২০:১৬
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক একটি দীর্ঘ এবং জটিল ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে। দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন চুক্তি এবং সমঝোতা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে তুলেছে। কিন্তু এসব চুক্তির বাস্তবায়নে, চুক্তির বৈষম্য এবং এক তরফা ভারতের পক্ষে সুযোগ বিতর্কের সৃষ্টি করেছে ।বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিগুলির বিশ্লেষণ করা সময় এসেছে। চুক্তিগুলো বাস্তবায়নে উদ্ভূত সমস্যাগুলি , বৈষম্য এবং কিছু অপ্রকাশিত চুক্তির বিষয়ে জনমনে আগ্রহ রয়েছে। ১৯৭২ সালের ১৫ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক চুক্তি। এই চুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল সীমান্ত নির্ধারণ এবং দুই দেশের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। চুক্তির আওতায়, সীমান্ত রেখা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয় এবং সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গৃহীত হয়। এর মধ্যে সীমান্তে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ এবং অস্ত্র চোরাচালান রোধের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
এছাড়া, চুক্তি সীমান্তে শান্তি এবং নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য একটি কাঠামো প্রদান করে। তবে, সীমান্ত নির্ধারণের পরও কিছু সীমান্ত এলাকার মধ্যে স্থানীয় জনগণের মধ্যে বিরোধ বজায় ছিল। বিশেষ করে, উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু সীমান্ত এলাকায় সীমান্ত বিরোধের সমস্যা এখনও বিদ্যমান। এই সীমান্ত সমস্যাগুলির সমাধান করতে গিয়ে চুক্তির বাস্তবায়নে নানা বাধা সৃষ্টি হয়েছে, যা দুই দেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলেছে।
১৯৯৬ সালের ৫ ডিসেম্বর গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির আওতায় গঙ্গার পানি ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলী নির্ধারণ করা হয়। চুক্তিতে বর্ষাকাল এবং শুষ্ক মৌসুমে পানি ভাগাভাগির জন্য একটি কাঠামো প্রদান করা হয়। এর সাথে, পানি ব্যবহারের তথ্য বিনিময় এবং পানি প্রবাহের পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়।
এই চুক্তির ফলে গঙ্গার পানি বণ্টনে একটি স্বচ্ছ নিয়মাবলী প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু বাস্তবায়নে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের কৃষি ও জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। চুক্তির আওতায়, পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি থাকলেও বাস্তবে তা অনেকাংশে পূর্ণ হয়নি। পানি সংকট মোকাবেলার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কিছু অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, যা চুক্তির বাস্তবায়নের দুর্বলতার একটি উদাহরণ।
২০১২ সালের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ নিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি বাঁধের নির্মাণ প্রক্রিয়া এবং বাংলাদেশের পরিবেশগত প্রভাব কমানোর প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। চুক্তির আওতায়, বাঁধ নির্মাণের সময় পরিবেশগত ক্ষতি কমানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
তবে, বাঁধের নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে নদীর প্রবাহ এবং পরিবেশগত পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে। বাঁধের নির্মাণের ফলে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রভাব এবং পরিবেশগত উদ্বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও চুক্তির আওতায় পরিবেশগত ক্ষতি কমানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, বাস্তবায়নে তা পর্যাপ্ত হয়নি। স্থানীয় জনগণ এবং পরিবেশবিদদের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করছেন, এই বাঁধ নির্মাণের ফলে সুরমা, কুশিয়ারা ও মেঘনা অববাহিকার ২৭৫ দশমিক ৫ বর্গকিলোমিটার এলাকায় পরিবেশ বিপর্যয়সহ এই অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি, জীববৈচিত্রের ওপর তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
টিপাইমুখ ড্যাম পরিচালনার পূর্বে যখন রিজার্ভেয়রটি পূর্ণ করা হবে তখন স্বাভাবিকভাবে এর ভাটিতে পানিপ্রবাহ বিঘ্নিত হবে, যা ওই অঞ্চলের স্বাভাবিক পরিবেশ ও ইকো সিস্টেমকে বাধাগ্রস্ত করবে। মৎস্য প্রজননে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। ( বাংলা নিউজ ২৪) ২০১৫ সালের শুল্ক ও বাণিজ্য বিষয়ক চুক্তি বাংলাদেশের ও ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নয়ন এবং সহজীকরণের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি শুল্ক ব্যবস্থাপনা এবং বাণিজ্যিক বাধা কমানোর জন্য নতুন নিয়মাবলী প্রণয়ন করে। তবে, এই চুক্তির বাস্তবায়নে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের পণ্যের প্রবেশে কিছু বাধা রয়েছে এবং ভারতীয় বাজারে প্রবেশে অসুবিধা রয়েছে। শুল্ক ব্যবস্থাপনায় অসঙ্গতি এবং বাণিজ্যিক বাধা ব্যবসায়ীদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করেছে। ফলে, চুক্তির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে।
২০১৮ সালে যুব উন্নয়ন এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি দুই দেশের যুব উন্নয়ন এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে যৌথ প্রকল্প গ্রহণের লক্ষ্যে গৃহীত হয়।
চুক্তির আওতায়, শিক্ষা বিনিময় এবং যুব উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য সহযোগিতা প্রদান করা হয়। তবে, প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু বিতর্ক দেখা দিয়েছে। যুব উন্নয়ন প্রকল্পে সহায়তার পরিমাণ এবং কার্যকরী পদক্ষেপের অভাব রয়েছে বলে কিছু অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কিছু চুক্তি এবং সমঝোতা এখনও প্রকাশিত হয়নি, যা সম্পর্কের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এসব অপ্রকাশিত চুক্তির মধ্যে সীমান্ত নিরাপত্তা, বাণিজ্যিক শর্তাবলী এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
সীমান্ত নিরাপত্তা চুক্তি: সীমান্ত নিরাপত্তা সম্পর্কিত কিছু অপ্রকাশিত চুক্তি রয়েছে, যা সীমান্ত নিরাপত্তা এবং সেনা মোতায়েনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। এই চুক্তির বিস্তারিত তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়নি, যা সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য গৃহীত পদক্ষেপের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে।
অপ্রকাশিত বাণিজ্য চুক্তি: বাণিজ্য সংক্রান্ত কিছু চুক্তির বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হয়নি। এসব চুক্তির মধ্যে শুল্ক এবং কাস্টমস সংক্রান্ত বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে, যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
জলবিদ্যুৎ প্রকল্প: জলবিদ্যুৎ প্রকল্প সম্পর্কিত কিছু অপ্রকাশিত চুক্তি রয়েছে, যা বাংলাদেশের পরিবেশগত পরিস্থিতি এবং নদীর পানি প্রবাহের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। এসব চুক্তির বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত না হওয়ার কারণে পরিবেশগত উদ্বেগ মেটানো হচ্ছে কিনা তা পরিষ্কার নয়।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নানা চুক্তি এবং সমঝোতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব চুক্তির মাধ্যমে সম্পর্কের উন্নয়ন এবং সহযোগিতা নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে বাস্তবায়নে বৈষম্য এবং বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। নদী পানি বণ্টন, বাণিজ্যিক সমস্যা, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং পরিবেশগত উদ্বেগের ম বলে অনেকেই মনে করছে। ভবিষ্যতে, এসব বিষয় নিয়ে সুষম ও স্বচ্ছ আলোচনা প্রয়োজন, যাতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরো শক্তিশালী এবং সমন্বিত হতে পারে। চুক্তির বাস্তবায়ন এবং সম্পর্কের উন্নয়নে দুই দেশের সমঝোতা ও সহযোগিতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: কবি , গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক [email protected]
বি.দ্র. মতামতটির জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়
বাংলাদেশ জার্নাল/এমপি