ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ আপডেট : ১৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

ভরা পেটে প্রাণী বলতে পারেন কম

  রাজীব কুমার দাশ

প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৪, ১৬:৫১

ভরা পেটে প্রাণী বলতে পারেন কম
প্রতীকী ছবি

আমার ফেসবুক বন্ধু তালিকার যে যাঁরা আছেন, তাঁদের সবাই না, কেউ কাউকে চলতি মাস আগস্ট, তারিখ পাঁচের আগেও দেখেছি, চরম চেতনাবাজ সেজে দেশের নানান কিসিমের এটা ওটা সমস্যা নিয়ে প্রবন্ধ নিবন্ধ ফেসবুক কবিতা লিখে নানান রঙ ঢং মেখে সযতনে ফেসবুক চেতনা স্টোর সাজিয়ে রেখেছেন।

দেখেছি, ঘরে ঘরে সবাই চেতনার পসরা সাজিয়ে ছোট ছোট বাচ্চাদের পর্যন্ত চেতনার বলিদানে কে কখন শহীদ হবে- আমার সোনামণি? মনে প্রাণে চিন্তার সঙ্গোপনে সন্তর্পণে - একাত্তর মুক্তিযোদ্ধা সুযোগ সুবিধা ভাতা পানে চেয়ে কবিতা লিখে লাইভ করে মিছিলে ঠেলে দিতে।

চেতনার অকাল বোধন কবিতা গান লিখে তাঁরা পেল কথিত নতুন স্বাধীনতা সুখ। বাহ্ বেশ তো। তাঁরা এখন চেতনা কবিতা গান কিছুই লেখেন না। তাদের এখন চেতনা মুড অফ। তাঁদের কপালে চিন্তার ভাঁজ। এখন তাঁদের এক এক জনের ফেসবুক ওয়াল খালি সাহারা মরুভূমি। তাঁদের সে ফেসবুক পেজ ওয়াল সাহারা মরুভূমিতে নতুন স্বাধীনতার দেশান্তরি কিছু ধীবর উদ্দেশ্যহীন একাকি হেঁটে চলেছেন।

আমি আছি, সে আগের মতো। আছি, আমার ট্রেনিং সময়কার সারদা পুলিশ একাডেমির ঝাড়ুদার হুরমতীর মতো। সে সময়ের বয়স ত্রিশোর্ধ হুরমতী বেঁচে থাকলেও মহাকালের হিশেব মতে সে বয়োবৃদ্ধ। আমাদের ফলইন সময়ে ফেটিগ হাবিলদার ওস্তাদ বেশ চেঁচিয়ে বলছেন, 'হুরমতী তোমার ঝাড়ু দেয়া হচ্ছে না। রাতে তোমার পুট আপ।' হাজার হোক, সে সেবক। তারওত মান-সন্মান আছে। তার পেটে রাজ্যের ক্ষুধা। সে চিৎকার করে বিহারী ভাষা মুখে বলছেন, 'আরে যা আবে যা। তোর মতো কত হাওলদার এ সারদায় এলো গেলো। আমি সুইপার হুরমতী হুরমতীই রয়ে গেলাম, ছালে চুতিয়া কুত্তা হারামি।' হাবিলদার সাহেব চুপ করে একগাল হতাশা নিয়ে চলে গেলেন।

বেঁচে আছি, পাগলের সুখ মনে কোনো পরিবর্তন ঝামেলাহীন ছাড়া আমাদের গ্রামের রসিক পাগলের মতন। রসিক পাগলের মতো করে তবুও কিছু বলি লিখি। বদ্বীপের নাখান্দা নাপাক বান্দা নালায়েকের নানান কিসিমের দু'চার কথা। আমাদের রসিক পাগল লেখেন, হাতে ধইঞ্চা কাঠি দিয়ে মেটো পথে। আমি লিখি হাঁটতে বসতে কাগজ কলমে ছাড়া মোবাইল টিপে। কারণ: আমিও অতশত বিদ্বান সাহেব চোস্ত চেতনাবাজ নই। আমি রাষ্ট্রের পদকহীন অভাজন। তাই সার্বক্ষণিক জবাবদিহিতা রসিক পাগল মনে লিখতে পারি।

নির্লজ্জ মনে রাষ্ট্রের সমুদয় কেড়ে নেয়া চোর ডাকাত বুর্জোয়া পদকখেকোদের বিরুদ্ধে ছিল আমার একাকি সংগ্রাম। সে একাকি সংগ্রামে আমার পাশে একজন বন্ধুও সাথে পাইনি। পাইনি, পুলিশ পাবলিক সামরিক একাট্টা মনের রসিক বিদ্বান অভাজন।

আমার বন্ধু সুশীল দল কেউ এখন লিখতে পারেন না। ঘেরাও ভয়ে বলতে পারেন না -তাদের নতুন গাড়ির মডেল দাম। চেপে যান, প্লট ফ্ল্যাটের নাম ঠিকানা দরদাম। বলতে পারেন না, তাঁদের দেশের বাড়ির জমি কেনার গল্প। বলতে পারেন না, দুধেল গরু খামার মাছ চাষের গল্প। বলতে পারেন না, তাদের শালির বোন ভোজালীর যতসব চুটকি গল্প। বলতে পারেন না, ব্যাংক পাড়ার জামাই আদুরের আদিখ্যেতা গল্প। তারা তাদের এতসব সম্পদ কী করবেন, কিংবা কোথায় রাখবেন? নিজেরাও বলতে পারেন না। তারা দুদক এনবিআর রাজনীতির গুণ্ডা পান্ডা পোষে এতদিন ধরে যে পরিমাণ হাদিয়া গল্পের চটুল গল্পের ধরণ; কিংবা রাজনীতি বাঘের হুঙ্কার ভয়ে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল কাঁপিয়ে রেখে নিরাপদে থেকেছেন; সে গল্প এখন ধীরে ধীরে বের হবার ভয়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। রাষ্ট্রের ইনিয়ে বিনিয়ে লুটেরা পদকখেকো একজনও মাছ কবি চাল ডাল কবি হয়ে পুলিশ সাংবাদিক সামরিক বেসামরিক কবি ফেসবুকে কিছু লেখেন না। মানে তারা বুঝে গেছেন,তাদের পেট ভরা। বের করে দিতে হবে ছাত্রদের সামনে। সে লুটেরা সম্পদ কয়েকজনম তাদের উত্তরসূরি চেঙ্গিস বসে বসে খেতে পারবেন। যাপিত সময় ক্ষুধা খালিপেটের ঘেরাও ভয়ে তারা বলতে পারেননা কোনো নীতিকথা এখন।

কথিত চেতনাবাজ সাংবাদিক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। মুখোশ পাল্টে কেউ কেউ নতুন লুকে হাজির হয়েছেন। কেউবা দোটানা মনে এমন পরিস্হিতি হবে জানলে ছাত্রদের সাপোর্ট করতাম না বলে, দাঁতে দাঁত চেপে নীরবে খিস্তিখেউড় করে চলেছেন। ঘেরাওপন্থীদের শিরদাঁড়া সোজা করে তর্জনী উঁচিয়ে চিৎকার করে বলতে পারছেন না,' আমি সৎ। কেন পদত্যাগ করব? ' মানে প্রতিবাদী হতে পারছেন না। যে যার মতো পদত্যাগ করে চলেছেন। সরকারি কোনো অফিসার প্রকাশ্যে সাহস করে চিৎকার করে বলতে পারছেন না,আমি দুর্নীতি করিনি। আমার হাত খালি। কোনো ব্যবসায়ী বলতে পারছেন না, আমি অবৈধ লাভ ভেজাল করিনি। প্রাক্তন ছাত্ররা বলতে পারছেন না বলে তারাও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। নতুনদের হাত পেট খালি বলে তাঁরা চিৎকার করে বলতে পারছেন। তাঁরা শ্লোগানে গণদাবী খসড়া মার্জিন প্রতিদিন পাল্টে নিচ্ছেন। তাঁরাও বলতে পারবেন কখন? পেটে ক্ষুধা থাকে যতক্ষণ ততক্ষণ।

শিশুরা কাঁদে তাদের পেটে ক্ষুধা থাকে যতক্ষণ। ক্ষুধা পেটে সকালে কাক ডাকে। ছাগল মোরগ গরু ডাকে। পেট ভরতি হবার পরে কেউ আর ডাকেনা। চুপচাপ থাকেন। তখন মিছিলে মিছিলে হয়না দ্রোহ প্রেম। কমিউনিস্ট ফেমিনিস্ট সন্ত্রাসী বুর্জোয়া কিংবা ধার্মিক সবাই একপাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। আবার ক্ষুধা পেটে বর্তমানের মতো করে, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য শ্লোগানে জেগে উঠেন।

আসলে এ ক্ষেত্রে কারোর একক দোষ দিয়ে লাভ নেই। প্রাণী ধর্ম জেনেটিক্যালি মডিফায়েড অর্গ্যানিজম এমন। প্রাণীর নিরাপদ পদের আহার মৈথুন শেষে এটা ওটা সেটা নিয়ে কাড়াকাড়ি কামড়াকামড়ি শেষে নির্ভেজাল ঘুম।

মানুষের সুখ সমৃদ্ধি অতল পেট ভরে যাবার পরে ঘাড়ের রোয়া শক্ত হয়না আগের মতোন। নেতা চোখে স্বাভাবিক অস্বাভাবিক জল আসেনা। চাষাভূষা সবাইকে বুকে জড়িয়ে নিতে পারেন কম। পেট ভরে যাবার পরে তার ফেসবুক গল্পে দেখা যায়,পরিবারের নানান ইন্টেরিয়র ডিজাইন করা বাড়ি গাড়ি গহনা পুকুর মৎস্য প্রজেক্ট। ফেসবুকে দেখা যায়,টাইমপাসের মুখরোচক যাবতীয় সুখ গল্প। সুন্দর সুন্দর হাসি। নানান রকমের ফ্যাশন উপঢৌকন ও কমেন্টস।

নেড়ি কুকুর, সিংহ চিতা হায়েনা নেকড়ে নিয়ে মানুষের যাপিত জীবনের সাদৃশ্য-বৈশাদৃশ্য চিন্তা করেছি। দেখেছি,- অক্ষম মানুষ জীবন বাঁচাতে পরিবার সমাজ রাষ্ট্রের কাছে এক একজন নেড়ি কুত্তার মতোন। তারা কখনো চা দোকানির নির্মম হাসিতে ছুঁড়ে দেয়া গরম পানি সহ্য করেন। আবার আয় আয় কাছে আয় ডাক মুখে নেড়ি কুত্তার মতো খুশিতে বেমালুম ভুলে কাছে গিয়ে পা চাটেন। পেট ভরতি সক্ষম মানব, হায়েনা সিংহ নেকড়ে মনে দিনরাত নিজেদের মাঝে গুঁতোগুঁতি করেন। কাড়াকাড়ি মারামারি করে এক সময় মরে যান।

মারপিট বাংলা সিনেমা স্ক্রিপ্ট রাইটার একসময় আমার কাছে মনে হত, সামাজিক জঞ্জাল। তাঁদের ছবিতে দেখতাম, সকল মাস্তান খুনি মন্ত্রী হয়ে সংসদে আইন পাশ করছেন। তারা থানা আক্রমণ করে সকল পুলিশকে মেরে ফেলেছেন। দেখেছি সৎ পুলিশ অফিসার চাকরি হারিয়ে জীবন বাঁচাতে ফেনসিডিল ব্যবসা করেছেন। পরে অনেক প্যাদানি খাবার পরে চাকরি পেয়ে অপরাধীকে ধরে এনেছেন। মানে সকল বাংলা সিনেমা দেখিয়েছেন, সততার পুরস্কার জেল জরিমানা অপমান ও মৃত্যু। নায়িকার শেষ আর্তনাদ, - আমার দেহ পাবি, মন পাবিনা কিন্তু। পরে খলনায়ক হেসে হেসে বলেছেন, শুধু দেহ পেলেই হবে। মনের দরকার নাই। দেখেছি ছোট ছোট শিশুরা স্বপ্নে দেখেছেন, তাদের কেউ কেউ হয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কেউবা হয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। তারা বেধড়ক পেটাচ্ছেন পুলিশ আমলা কামলা নেতা মন্ত্রী। তারা ভিলেন পুলিশ মেরে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে রেখেছেন। তাদের হাতে ধরা পড়েছেন অনেক অসাধু নেতা মন্ত্রী। জনতার আদালতে নায়ক নায়িকা তাদের মেরে উল্লাস করে চলেছেন। রাষ্ট্রপতি উৎসুক ছাত্র জনতার সকল অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছেন। আরো দেখেছি, কখনো নায়ক কখনো খলনায়কের সাথে আমজনতার মিছিলঃ 'জেলের তালা ভাঙবো। ডিপজল ভাইকে আনবো।'

লেখালেখির কারণে বাংলা সিনেমার স্ক্রিপ্ট রাইটার অনেকজনের সাথে নানান কথা হয়। তাঁদের অধিকাংশের মতামতঃ 'সবকিছু মানুষের উর্বর অনুর্বর কল্পনাশক্তির ফসল। মানুষ যা যা কল্পনা করেন, কামনা করেন! তা সৃষ্টিকর্তা কিংবা প্রকৃতি নিরাশ করেন না।'

একজনমে নানান বাংলা সিনেমা ডায়ালগ দেখে ও শোনে মনে হয়, আমিও লিখে চলেছি- ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল ব্যেপে প্রতি ঘরে ঘরে একদিন নতুন করে স্বনির্ভর স্বাধীনতা আসবে। তারা মানবেনা ভরা পেটের শাসন। একটি করে নতুন রাষ্ট্র হবে। তাদের ঘরে ঘরে হবে নিজস্বী খেয়ে পরে বাঁচা নিশান। রচিত হবে, কারোর মনোদাস দলদাস সেবাদাস না হবার সংবিধান। তারা মানবেনা রাষ্ট্র সংবিধানের মিথ্যা জুজুর ভয়। মানবেনা জনমিতিক বেহাল অন্যায়। শোনবেনা তাঁদের দাবিয়ে রাখার নানান কথামালা মিথ্যা অভয় বাণী। তারা সবাই যে যার মতো করে বলতে পারবে। লিখতে পারবে। গাইতে পারবে। তাদের থাকবে নিজস্ব প্রার্থনা সংস্কৃতি মুক্ত মনের অধিকার। তারা যে যার প্রতিবেশি হবেন, লাল গালিচা না হোক; অন্তত: একটি দুর্বল রাষ্ট্রের অবকাঠামোগত মর্যাদা সন্মান পেয়ে রাজা পুরুর মতো ইতিহাস মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকবেন।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কবি।

বি. দ্র. মতামতটির জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত