গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ: সংবিধান, সীমাবদ্ধতা এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
আবু জুবায়ের
প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৪, ২০:২১ আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০২৪, ২০:৩৪
গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারের পতন ও নতুন সরকার গঠন একটি জটিল ও সংবেদনশীল প্রক্রিয়া। ইতোমধ্যেই অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন একটি সরকার গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে একটি সুনির্দিষ্ট পথ অতিক্রম করতে হবে বলে অনেকেই মনে করেন। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে এই ধরনের পরিস্থিতি পরিচালনা করার জন্য সাংবিধানিক বিধান রয়েছে অন্যদিকে কিছু সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতাও পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে, নতুন এই সরকার কিভাবে পরিচালিত হবে এবং কতদিনের জন্য ক্ষমতায় থাকবে, সে বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে, কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে দীর্ঘকাল অনির্বাচিত সরকার থাকা সম্ভব কি না এবং এর সঙ্গে অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা কী বলছে তা বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের সংবিধান ও সরকার গঠন
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচিত সংসদ পাঁচ বছর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকে। কিন্তু, যদি নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সংসদ ভেঙে যায় বা সরকারের মেয়াদ শেষ হয়, তাহলে ৯০ দিনের মধ্যে একটি নতুন নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যা সংবিধানের ৭২(২) ধারা দ্বারা নির্ধারিত। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হলে নির্বাচন কমিশন ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করে এবং বিএনপি বিজয়ী হয়।
যদি বিশেষ পরিস্থিতিতে নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব না হয়, যেমন জাতীয় দুর্যোগ, যুদ্ধ বা গুরুতর রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৩ ধারা অনুযায়ী একটি অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন, যা অস্থায়ীভাবে সরকারকে ক্ষমতায় থাকার অনুমতি হিসাবে দেখা যেতে পারে। তবে, এই অধ্যাদেশটি আইনগতভাবে সীমিত সময়ের জন্য কার্যকর এবং সাধারণত নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারের আসা না পর্যন্ত ব্যবহৃত করা যেতে পারে। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল যা সামরিক শাসন ও অস্থায়ী সরকার পরিচালনার পথ তৈরি করে।
বিশেষ পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদি সরকার
বাংলাদেশে বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকারের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষমতায় থাকার কিছু বিধি রয়েছে:
জরুরি অবস্থা: সংবিধানের ১৪১(A) ধারা অনুযায়ী, জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলে সরকার প্রয়োজনে তার মেয়াদ বাড়াতে পারে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে সরকার দুই বছর বা তার বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকতে পারে। অন্যদিকে পরবর্তী সংসদ রেট্রোস্পেকটিভলি এই সরকারের কার্যকালকে অনুমোদন প্রদান করতে পারে।
অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা: আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা করেছে। তবে, বিশেষ পরিস্থিতিতে নির্বাচন আয়োজন না হলে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকে। তবে প্রয়োজনে এর মেয়াদ বাড়ানো যেতে পারে বলে অনেকেই মনে করে সেক্ষেত্রে আদালতের মাধ্যমে বিষয়টিকে অনুমোদন নেওয়া যায় কিনা সেটা খতিয়ে দেখা জরুরি। ২০০৭-২০০৮ সালে, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছিল। এই সরকার প্রায় ২ বছর ক্ষমতায় ছিল এবং নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠিত হয়।
গণঅভ্যুত্থান এবং পরবর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়া বোঝার জন্য আন্তর্জাতিক উদাহরণও গুরুত্বপূর্ণ। ২০১১ সালের মিশর বিপ্লবের পর হোসনি মোবারক সরকারের পতন ঘটে। সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে। তাঁরা প্রায় দুই বছর পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। এই সময়ে নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং নির্বাচন আয়োজন করা হয়। ২০১৩ সালে মোর্সির সরকার পতনের পর সামরিক বাহিনী একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে এবং নতুন নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদেল ফাত্তাহ আস সিসি ক্ষমতায় আসেন।তিনি এখনও সেখানে ক্ষমতায় আছেন।
২০১৪ সালে থাইল্যান্ডে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করা হয় এবং সামরিক বাহিনী প্রায় পাঁচ বছর ধরে ক্ষমতায় ছিল। সামরিক বাহিনী একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনা করে এবং ধীরে ধীরে নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হয়। ২০১৯ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে থাইল্যান্ডের সামরিক শাসনের অবসান ঘটে এবং একটি নতুন গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৯৯ সালে পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পারভেজ মোশাররফ ক্ষমতায় আসেন এবং একাধিকবার মেয়াদ বাড়ানোর মাধ্যমে প্রায় আট বছর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকেন। তবে, এই সময়ে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পায়। ২০০৭ সালে পাকিস্তানে জরুরি অবস্থার ঘোষণা দিয়ে মোশাররফ দীর্ঘমেয়াদী ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করেন, কিন্তু এর ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায় এবং জনগণের বিরোধিতার মুখে পড়েন।
দীর্ঘমেয়াদি সরকারের আইনি ও নৈতিক সীমাবদ্ধতা
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দীর্ঘমেয়াদি সরকার প্রতিষ্ঠা বিশেষত নির্বাচনের অনুপস্থিতিতে বৈধ ও নৈতিকভাবে কতটা গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বাংলাদেশের সংবিধানে অনির্বাচিত দীর্ঘমেয়াদি সরকারের জন্য সরাসরি কোনো বিশেষ বিধান নেই, তবে জরুরি অবস্থার ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয়তা দেওয়া হয়েছে।
যদি জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া সরকার দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্ষমতায় থাকে তবে তা গণতন্ত্রের মূলে আঘাত হানে এবং আইনের শাসন নিয়ে প্রশ্ন সৃষ্টি হতে পারে।
গণঅভ্যুত্থান বা বিপ্লবের পর বাংলাদেশে সরকার গঠনের প্রক্রিয়ায় সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা, বিশেষ পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিতে হবে। বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার দুই বছর বা তার বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকতে পারে তবে এর জন্য জনগণের সমর্থন এবং আইনি অনুমোদন অত্যন্ত জরুরি। অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় গণতন্ত্রের মূলে আঘাত না করে, জনগণের অধিকার ও আইনের শাসন বজায় রাখার শর্তে সরকার পরিচালনা করা উচিত। আখেরে অবাধ, নিরপেক্ষ, সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা ও শান্তির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণই একমাত্র উপায়।
লেখক: কবি, গবেষক, কলামিস্ট, প্যারিস, ফ্রান্স।
বি.দ্র. মতামতটির জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।
বাংলাদেশ জার্নাল/এমপি