ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১ আপডেট : ৩ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

ভাসমাননামা

  রাজীব কুমার দাশ

প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৪, ২১:৫৬

ভাসমাননামা
রাজীব কুমার দাশ। ফাইল ছবি

প্রাণী মানে ভাসমান। প্রাণী জীবন আক্ষরিক অর্থে ভাসমান। হোক না সে পশু পাখি সরীসৃপ জীবন কিংবা মানব জীবন। পৃথিবীতে এক এক দিন টিকে থাকাই মহান। প্রতিনিয়ত প্রাণী সে টিকে থাকার লড়াই যুদ্ধ ঘরে বাইরে চালিয়ে যাচ্ছেন।

বেঁচে থাকার দৌড়ে কেউ থেমে নেই। তবে, সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে মহান বলবার কারণ: তার বোধ বিচার অন্য প্রাণী হতে স্বতন্ত্র। বেঁচে থাকার অদম্য নিরলস লড়াই কিংবা পরিশ্রম তা অন্য প্রাণী হতে অনেকাংশে কম করে থাকেন। মানুষের পাকস্হলী ছোট, আহার লাগে অনেক কম। খেয়ে জাবর কাটতে হয় না। খাবার শেষ করতে লাগে মিনিট পাঁচেক। দিনান্তে যা রোজগেরে পরিশ্রম করেন,তা দিয়ে অনায়াসে সে কাটিয়ে দিতে পারেন; কামড়াকামড়ি ছাড়া আপামর জীবন।

মানুষের হাতে কত শত কিতাব ধর্মগ্রন্থ ঐশীগ্রন্থ। কত শত বাছবিচার বই, মতবাদ সাহিত্য। তারপরেও মানুষ নামের এ প্রাণী থেকেছেন নিজস্বীহারা চেতনাহীন সর্বস্বহারা ভাসমান। সে নিজে নিজের বিচার করতে পারেননা। পৃথিবীতে তার আসা যাওয়া গড় বছর আয়ু ৭০/৮০ নিয়ে তার নিজের কথা নিজে বলে যেতে পারেননা। পৃথিবীতে কেবল আসা যাওয়া সার চৌদ্দ আনা পার মনে কেবল নিজেরটা আখের গোছানো ছাড়া পরেরটা বুঝতে চান না একদম।

বিদেশ ফেরত পৌঢ় মোঃ বেলাল। বয়স পঞ্চাশ একান্ন মধ্যবর্তী অঞ্চল।

দশ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার মামলার আসামি। রাতে কিংবা সকালে পরিবার পরিজন কেউ দেখা করতে আসেননি। শরীর বেশ দুর্বল। দাঁড়াতে পারছেন না। কিছু না বলে হঠাৎ ধপাস করে মেঝেতে বসে পড়লেন। তদন্তকারী অফিসার এসআই শিহাব উদ্দিন রুটি কলা চা খাইয়ে কোর্ট ফরওয়ার্ডিং তৈরি করে চলেছেন।

- আপনার নাম?

: বেলাল।

- ঠিকানা?

: আগে ছিল। এখন ভাসমান।

- মানে?

: স্যার। পরিবারে আমি ছিলাম বড়। দেশে রাজমিস্ত্রি ছিলাম। সৌদি গিয়ে

টাকা পয়সা যা কামাই করেছি, তা দিয়ে আমরা পাঁচ ভায়ের ঘর করেছি।

জমি কিনেছি। পরে বিয়ে করি। একজন মেয়ে আছে। বয়স হবে দশ।

বছরে একবার করে আসি। মাসেক ছুটি কাটিয়ে চলে যাই। বছর চারেক আগে দেশে আসার পরে বাবা মা ভাই মিলে শালিস বসায়। শালিসে বাবা জানায়,ভিটে বাড়ি কেনা জমি, পাকা ঘরে আমার কোনো হক নাই। বাবা মা'র সন্মানের দিকে তাকিয়ে বলেছি, আব্বা যা বলেছেন,সত্য। সেদিন এক কাপড়ে বাড়ি হতে বের হয়েছি। পিতার কর্তৃত্ব পরিচয়ে আমি যা হকদার ছিলাম, তার সবটুকু কেড়ে নেয়া হয়েছে। তখন হতে হয়েছি ভাসমান।

পরে ক'দিন শ্বশুড় বাড়িতে থেকে পাশে নতুন করে জায়গা কিনে ঘর করেছি। আমার মেয়েটা রূপনগর সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস টু'তে পড়ে। বিভিন্ন ঝামেলার কারণে এ জায়গা বাড়ি আমার স্ত্রী রুবিনা আফরোজার নামে করেছি। আমাদের দুই নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার করিম উদ্দিন বাড়ির কাজের কন্ট্রাক্ট নেয়। পরে আমার অনুপস্হিতিতে.....সর্বনাশ যা হবার হয়েছে। আমার এই বাড়িঘর টাকা পয়সা এখন তাদের হয়। পরে মনের দুঃখে ইয়াবা ধরি। আমার দুই ঠিকানা এখন ভাসমান।

দারোগা সাহেব চিন্তিত হলেন। কলম চলে চলেনা। কয়েক পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে আসামি বেলালের ভাসনামনামা তৈরি করে দেন। সে ভাসমাননামা ভেলা চেপে কোর্টে নাম হয় হাজতী বেলাল।

বেলাল মাঝে মাঝে আসামী গাড়ি চেপে কোর্টে আসেন। বিচারক সাহেব অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেন। প্রতিবার পড়েন ভাসমাননামা বেলাল। সে ভাসমাননামা মানচিত্রে দেখা যায়, বেলালের স্ত্রী ও মেয়ে মাইশার কত শত খুনসুটি গুহা নদী মেঠোপথ আলপথ।

ভাসমাননামা ভেলা চেপে বেলাল ঘুরছে ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল। বেলালের জাঁদরেল উকিল নাই। চার্জ গঠনে বেলালের সহজ সরল স্বীকারোক্তি দিয়ে পরে বেনিফিট অফ দ্য ডাউট নিতে চান না বেলাল। নির্ঘাত শাস্তি যাবজ্জীবন।

কয়েদখানার বন্দী শত হাজার কয়েদী বেলালের চাপা কান্না আর্তনাদ শোনার কেউ নেই। অ্যাডভান্সড পরকালের প্রস্তুতি টিকেট বেলালের হাতে। সে টিকেট হাতে বেলাল হাসতে চেয়ে হাসেনা,কাঁদতে চেয়ে কাঁদেন কম। বেলাল মনে প্রাণে পরপারের মানুষ মনে কাউকে চিনতে পারেন কম।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কবি, পুলিশ পরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত