‘স্বার্থছাড়া বীর বাঙালি বায়ুকর্ম সারেন এমন নজির কম’
রাজীব কুমার দাশ
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৪, ১৬:৪৭
শ্রদ্ধেয় লেখক, আহমদ ছফার মতো করে এই পামর বাঙালি জাতিকে খুব কাছে থেকে কেউ দেখেন নাই। তেমন করে কেউ চিনতে পারেন নাই। পরে চিনেছেন আরেকজন। বেহাত বিপ্লব স্রস্টা নমস্য লেখক, অধ্যাপক ড. সলিমুল্লাহ খান। তারপরে চিনেছেন, প্রথাবিরোধী লেখক ড. হুমায়ুন আজাদ। তাঁদের লোকায়ত সাহিত্য দর্শনে হয়ে আমার গবেষণ মন বলে, বাঙালি মানে একজন ট্রল। বাঙালি মানে বাংলা হিন্দী উর্দু হিন্দুস্তান পাকিস্তান সৌদি রক্ষণশীল বুদ্ধিজীবি বিশারদ ভার্সন। বাঙালি মানে মার্কিন ইউরোপ হট ডগ চোস্ত সংস্কৃতি, কমিউনিস্ট কমরেড চে ফিদেল কিংবা রুশ ফৌজি মডেল। বাঙালি মানে পাক আফগান ইন্ডিয়ান সিরিয়া তুরস্ক হামাস হুতি নানান চরিত্রের বায়োপিক সিনেমা। বাঙালি মানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য মহারাজা স্তাবক মিশেল সাহিত্য দর্শন। বাঙালি মানে ক্ষুধা পেটের এক একজন রুমি পণ্ডিত। বাঙালি মানে কপর্দকহীন নীতিবান দেশপ্রেমিক সৈনিক। বাঙালি মানে এক একজন ধন্বন্তরি চিকিৎসক। বাঙালি মানে বিজ্ঞানী মনোবিজ্ঞানী মহাপন্ডিত ধর্মবিজ্ঞানী স্তাবক গবেষক। বাঙালি মানে দিন শেষে রাতের আঁধারে এক একজন মীরজাফর মোহাম্মদি বেগ রোল মডেল। কী নাই! বাঙালিয়ানা চরিত্রে?
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আদলে জাতীয়তা বাঙালি জনগোষ্ঠীর বৈষম্যবিরোধী পুঞ্জীভূত ক্ষোভের মহাবিস্ফোরণ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যত যত বিপ্লব ঘটেছে, সবকটিই হয়েছে এটা ওটার বৈষম্য নিয়ে। মানুষের মুখের ভাষা ঐশ্বরিক চিরন্তন পাখির মতোন। তাকে বলতে দিতে হবে। বলার অধিকার দিতে হবে। থাকুক না সে কথায় সাদৃশ্য - বৈশাদৃশ্য নির্ভেজাল বৈরিতা। প্রাণী মাত্রই চিরকালিক একরোখা বুনো গোঁয়ার স্বাধীন।
তার মুক্ত কথার সমকালীন মূল্য পরিশোধ করার দুঃসাহস ইহলোকের কারোর নাই। তাই মানুষকে যতসব ভয়ঙ্কর সুপারসনিক ধ্বংসাত্মক হযবরল আণবিক চিন্তা হতে নিবৃত্ত রাখতে পারেন - একমাত্র জ্ঞান।
জ্ঞানই মানুষের নির্ভেজাল পরম বন্ধু। সে কারণে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট আক্ষেপ করে সরাসরি বলেছিলেন, ' যদি আমি আলেকজান্ডার না হতাম, ' দার্শনিক ডায়োজেনিস দ্য সিনিক হতে পছন্দ করা উচিত ছিল এমন। '
জ্ঞাণী মানুষের খোঁজে থাকা ক্ষ্যাপাটে দার্শনিক ডায়োজেনিস রাস্তার বিশাল একটি পরিত্যক্ত টব বা মদের ভাড়ে বসবাস করতেন। সার্বক্ষণিক সঙ্গি থাকত কয়েকটা কুকুর। কারোর কাছে হাত পেতে চেয়েচিন্তে নেবার আগে বলতেন,' তোমাদের কারোর কাছে কিছু চাইবার আমার অধিকার আছে। কারণ আমি সম্পূৃর্ণ স্বাধীন।'
আয়েশী জীবন কাটানোর প্রস্তাব দিলে আলেকজান্ডারকে তাঁর ধারে কাছে যেতে পর্যন্ত নিষেধ করেছিলেন। এমনকী বলেছিলেন,' আরে বাপু! সরে বসো। তোমার জন্যে সকালের সুন্দর রোদটুকু পর্যন্ত উপভোগ করতে পারছিনা এখন। '
সে একাত্তরের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে মহান মুক্তিযুদ্ধের সিংহভাগ গর্বিত অংশীদার ছিলেন, গ্রাম বাংলার আধাপেটের ভুখারি নিরন্ন কৃষক শ্রমিক, কামার কুমোর চাষাভূষা মজদুর। তাঁদের স্বপ্ন ছিল দু'বেলা সানকিভরতি পেটভরে ভাত খাবে। পান চিবোতে চিবোতে মুখে বিড়ি ফুঁকে মাথায় গামছা বেঁধে পুঁথি জারি সারি যাত্রা গান দেখার আবেদন নিবেদন। তাদের সস্তান হবেন,এক একজন বৈষম্যবিরোধী নির্ভেজাল মানুষের মতোন মানুষ হবেন এমন।
কবিদের আবদার ছিল, তাঁরা মনের সুখে লিখবেন। লিখার সময় চিন্তা করতে হবেনা,মৃত্যু জেল জরিমানা পাছে আছে এমন। জেল জরিমানা বেইজ্জতি ভয়ে লিখতে হবেনা কাটতে হবেনা এক লেখা বার বার। কেটে কুটে পাঠক মনে কোনটা প্রবন্ধ কোনটা নিবন্ধ কোনটা গল্প পড়ে বুঝতে অসুবিধে হবেনা কী হবে না হবে কোনটা কী এমন। কবিতা হবে না অকবিতা। লিখে কাউকে চাকরি মর্যাদা হারাতে হবেনা, গর্দান যাবেনা। পালিয়ে বেড়াতে হবেনা। কাটাতে হবেনা নির্ঘুম রাত দিনের পর দিন। সে বৈষম্যবিরোধী একাত্তর স্বাধীনতার সুফল চোখের সামনে ধাপে ধাপে বেহাত হয়ে গেল। সে বিপ্লবের সুবিধাভোগী ফসল কার ঘরে চলে গেল..? এবার দেখে নেয়া যাক।
: না মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন পূরণ হলো? : না নিরন্ন চাষাভূষা ভূখারা পেল ?
মুক্তিযুদ্ধের সে সমৃদ্ধ বৈষম্যবিরোধী ফসল চিরতরে বেহাত হলো। তবুও থেকে যায় - অনেক কথা বহুকথা নানান কথা। মুক্তিযুদ্ধের মূল শক্তি ছিল বৈষম্য বিরোধী সাম্য দর্শন। কিন্তু ধীরে ধীরে নিরন্ন ভূখারিদের চোখের সামনে যখন তর তর করে হঠাৎ কেউ কেউ আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে থাকলেন; সে বৈষম্যবিরোধী বিপ্লবের কিয়দংশ নয় আধাআধি মুক্তিযুদ্ধ চেতনা খসে পড়েছিল তখন।
তারপরে একটু আধটু যা ছিলো, জাতীয় সম্পদ ও সম্পত্তি হতে ধীরে ধীরে বেধড়ক ঘুস চুরি দুর্নীতি ডাকাতি জাতীয় সংস্কৃতি হয়ে রাতারাতি দিনের পর দিন এর ওর ঘরে ভাগবন্টনে চলে গেল। কিন্তু এক সময় সে লুটেরাদের মনে এলো সারি সারি প্রশ্ন? তারা এত এত জাতীয় আমানত খেয়ানত সুযোগের সম্পদ কোথায় লুকিয়ে রাখবেন ?
মানে,সমানে যে যার মতো করে দেশের টাকা সম্পদ চেঙ্গিস মনে বিদেশে চালান করতে থাকলেন দিনের পর দিন। জবাবদিহিতার নাই সংস্কৃতি সুযোগ মনে দেশে রাতারাতি বাড়ি গাড়ি করে রাষ্ট্রের দুদক পুলিশ হতে শুরু হয়ে বিসিএস চয়েস ক্যাডার সুশীল দাদন ব্যবসায়ী ব্যাংক ম্যানেজার অফিসার কেরানি পিয়ন হয়ে এমনকী রাষ্ট্রের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী, মাদক ব্যাসায়ী, সিন্ডিকেট কাঁচামালের ব্যবসায়ী, স্কুল মাস্টার কোচিং ব্যবসায়ী পর্যন্ত বিদেশে দেশের সম্পত্তি ও সম্পদ চিরতরে চালান করে দিলেন।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সাম্য চেতনা ও দর্শন অর্থনৈতিক মুক্তি, - চেঙ্গিস লুটেরা মনে অসাম্য বিপ্লব লুটেরা ঘোড়া চেপে পুনরায় চিরতরে বাংলাদেশ হতে হারিয়ে গেলেন। রাষ্ট্রের ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচার চিরতরে ঘুমিয়ে গেলেন।
তারপরে ও রাষ্ট্র বেঁচে রইলেন। হারাধনের বেঁচে থাকা এক ছেলের পরিবার পরিজন আবার জেগে উঠল। তাঁরা কচুর লতি হয়ে এটা ওটা রপ্তানী করে প্রবাস জীবনের ঘাম ঝড়ানো রেমিট্যান্স হাতে দেশকে সমৃদ্ধশালী করে দিলেন। বছর পনের ধরে আবারো যে লাউ সে কদু নীতিতে রাষ্ট্রের সরকারি বেসরকারি সবখানে সিন্ডিকেট জেঁকে বসলেন। এক সময়ের খেতে না পারা হাত পাতা চাটুকার দালাল ফুটপাতের কাঙাল হতে শুরু করে নানান কিসিমের এটা সেটার চোর ভাঙারি ব্যবসায়ী হয়ে দারোগা ওসি তহশীলদার এসি ল্যান্ড এসপি ডিসি সাংবাদিক হয়ে সরকারি নির্দ্দিষ্ট চয়েস ভর্তুকি উপদেষ্টা বিসিএস ক্যাডার হয়ে বাম ডান বুদ্ধিজীবি ধর্মজীবি, এমনকী পাতি নেতার ঘরে ঘরে পর্যন্ত এসি বাড়ি গাড়ি হল। সরকারের নানান প্রজেক্ট বরাদ্দ মেরে কোটি কোটি টাকার প্লট ফ্ল্যাট বাড়ি গাড়ি বডি গার্ড নিয়ে যে যার মতো দিনেদুপুরে ব্যাংকগুলেো ঠাঁয় খালি করে দিলেনন ।
রাষ্ট্র আবারো হারাধনের দশ ছেলের সন্তানের বাকি এক সন্তানের নাতি পুতি কৃষক মজদুর কামার কুমোর আমি তুমি সে মজদুরের হাতে ক্রীতদাস হুকুম দাস হয়ে সেবাদাস মনে মহান মুক্তিযুদ্ধের বাকি ইতিহাস খুঁজে নিতে ঘোড়ার জিন লাগাম রশি খানা আমাদের চাষাভূষাদের হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি তুমি সে রাষ্ট্র হারাধনের নাতি পুতিরা টেনে টেনে চাষাভূষা মিলে এখন বৈষম্যবিরোধী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা খুঁজি - কখনো বিবিধ মন্ত্রণালয়, শাহবাগ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। জাহাঙ্গীর নগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়,জাতীয় সংসদ কিংবা সচিবালয়। কিন্তু যেখানে যাই, সবখানে সবাইকে দেখতে পাই রাষ্ট্র হারাধনের চেতনা হারা সকল সন্তানেরা দাঁতকেলিয়ে হাসেন।
সে একাত্তর পেরিয়ে দু'হাজার চব্বিশ।
উন্মত্ত পদ্মা মেঘনা যমুনা গিলে চলেছে ঘর বাড়ি জমি-জিরাত আগের মতোন। হাঁদা ভোঁদা সিরিয়ালের ইচ্ছাপূরণ বাংলা সিনেমা নিয়ে চলেছে এ জাতির আশা ভরসা। এখন বাঙালির নেই একজন আবদুল আলীম। যে কিনা তাঁর করুণ গানে থামিয়ে দিতে পারেন, পদ্মা মেঘনা যমুনা ভাঙন। আমাদের নেই একজন স্বর্গ নরক মীমাংসা দিশা দেখানো কবি ফজলল করিম। এত টাকা দিয়া কী করব খ্যাত বাউল শাহ আবদুল করিম।
যে কিনা তাঁর গানে গানে ভেঙে দিতে পারেন, মানুষের যতসব মিথ্যে অহম। ঠেকিয়ে দিতে পারেন ধর্মের বিভাজন।স্বার্থ ছাড়া বীর বাঙালি বায়ুকর্ম সারেন এমন নজির কম, জাতীয় বাঙালি সংসারে আমাদের গর্বের পণ্ডিত ও দার্শনিক ড. সলিমুল্লাহ খান অনেক অনেক বেশি প্রয়োজন।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কবি, পুলিশ পরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ।