ঢাকা, রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১ আপডেট : ৮ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

ট্রাম্পেট

  রাজীব কুমার দাশ

প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২৪, ১৬:২৩

ট্রাম্পেট
রাজীব কুমার দাশ। ফাইল ছবি

ত্রিপ্রহর রাত। ভৈরবী ঠাটে রাগ মালকোষে সেলিম মিয়া ট্রাম্পেট বাজিয়ে চলেছেন। দমের কাজকাম। সামরিক নিয়মানুবর্তিতা মেনে আঙুলের থেরাপিউটিক বেনিফিট নিয়ে সেলিম মিয়া -ট্রাম্পেট বাজিয়ে একাই আসর মাতিয়ে রেখেছেন। বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠান। সানাইয়ের সাথে বন্ধুত্ব সেরে, ঢোল নাগারা ঝুমঝুমি সামলে নিয়ে ট্রাম্পেট সুর যখন মানুষের পাষাণ হৃদয় গহীনে জমানো প্রতিপত্তি এবং আভিজাত্যের মিথ্যা অহংবোধ নড়বড়ে করে দেয়; বিয়ে বাড়ির অজানা অচেনা মানুষ নড়েচড়ে বসে। থমকে দাঁড়ায়, বিয়েবাড়ির ডিজে কোলাহল। মনের অজান্তে গণ্ডদেশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে নোনা জল। মূর্ত ও বিমূর্ত মিশেল আবছায়া মনে দুন্দুভি হাতে ছুটে আসে স্বর্গের অপ্সরা ঐকবাদন দল। মঞ্চে থাকা বর কনে মনে করেন, এই সুর তারা খুঁজেছেন জনম জনম। এই আলাপন তাল লয় যেন তাদের চিরচেনা মরমে মরমে হৃদয়গাঁথা মনের অজান্তে তপোবনে সেরেছে আলাপন এমন।

পাথরঘাটা দরবার ব্যান্ড পার্টির প্রতিষ্ঠাকাল হতে সেলিম মিয়া বেলুন ভরতি দম মুখে ট্রাম্পেট বাজিয়ে চলেছেন। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা,উপজেলা নবীনগর।

সেলিম এক সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া গোপাল সার্কাস ও যাত্রাদলে কাজ করতেন। কমরেড গোপাল হাতে বুর্জোয়া সামন্তপ্রথা সামন্ততন্ত্র শ্রেণী সংগ্রাম শ্রেণীশত্রু কি কেমন - হাতে কলমে তাত্ত্বিক পাঠে জেনেছেন। উদ্বোধনী সংগীতে প্রথমে জাতীয় সঙ্গীত সেরে ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য,পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, মানুষ মানুষের জন্য ট্রাম্পেট সুরে বাজিয়ে সেলিমের ঘাড়ের রগ ফুলে যেত। সে ঘাড় ফোলা রগে দেখা যেত,পদ্মা মেঘনা যমুনা বুড়িগঙ্গা বিরান হাহাকার পাহাড় সুন্দরবন। সেখানে পালিয়ে বেড়ায়, কিছু নিরীহ মাছ চিত্রা মায়া হরিণ। সহজ সরল বুনো দাঁতাল শুঁয়োর। গজার বোয়াল শোল রাক্ষুসে সামন্তপ্রভু মাছের ভয়ে পরানভরে দৌড়াতে থাকে মানুষের মতো করে সাধারণ অতি সাধারণ সাদাসিধে মাছ এমন।

কপোল চুইয়ে পড়া ঘামে দেখা মিলত সর্বস্বহারা রিক্ত সিক্ত নিঃস্ব দিশেহারা কিছু জীবন। মালটানা জোয়াল বাঁধা গরু মোষের মতো চলার পথে যা পায়, তা খেয়ে সারারাত চলত সেলিমের ক্যারিশম্যাটিক ট্রাম্পেট বাহাদুরি। রাগ ভৈরবী দিয়ে শুরু করে ইমন বাগেশ্রী রাগ মল্লার দখল নিয়ে রাত পার করে সকালে ঘরে ফিরত।

ছিমছাম পিয়ালি গ্রাম। গ্রামের ঘরে ঘরে চলত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম হাতেখড়ি সাধনা। ঘরে ঘরে অভাব ছিল। তবুও মানুষের স্বভাব ভালো ছিল। মিথ্যা বলত কম। বিনোদনের মাধ্যম ছিল - পুঁথিপাঠ, কলের গান,যাত্রা, সার্কাস এমন।

বিধি কালের আগুনে গোপালের যাত্রা সার্কাস প্যান্ডেল পুড়ে গেল। হাতি ঘোড়া পোড়া কাবাব মাটি চাপা দিয়ে গোপাল ধার দেনা বোঝা চেপে নিরুদ্দেশ যাত্রা কবিতা হয়ে অজানার পথে চিরতরে হারিয়ে গেল।

একমাত্র মেয়ে রুবি। ইন্টার পাশ। রাতে বাবা সেলিমের মুখে হারানো গোপাল সার্কাস যাত্রা গল্প শোনেন। বাবা মুখে জানতে পারেন,সার্কাসের হাতিটার নাম বাহাদুর ছিলো এমন। সার্কাস জীবনে মাঝে মাঝে বাহাদুর মন খারাপ করত। নীরবে কান্না করত। মানুষের মতো করে ইথার বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে সেও তার হারানো মোকামের খবর নিত। রহস্য প্রজনন মা কচ্ছপ ডিমে থাকা বাচ্চাদের জড়িয়ে রেখে হাজার মাইল দূরে থেকে কোনোদিনও না দেখে যেভাবে স্নেহ করেন; কেড়ে নেন না দেখাদেখি হাপিত্যেশ কান্না; হস্তী বাহাদুরও প্রশ্নমনে তার হারানো মাকে জিজ্ঞেস করত অমন করেঃ

- আচ্ছা মা,তোমার আর বাবার সামনে আমি কী করে পাচার হয়ে গেলাম?

: পুত্র। তুমি ছিলে তখন আবাল। মানুষের পাতানো খেদা ফাঁদে কলাগাছ ভরতি বাগান দেখে তোমায় না যেতে টেনে ধরেছি। বার বার না যেতে নিষেধ করেছি। ওখানে থাকা আমাদের স্বজাতি চামচা হাতি দুষ্ট হাসি দেখে তোমায় সতর্ক করেছি।

- জানো মা, আমার না খুব কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে মাহুত ব্যাটা খাবার দেয় না। সারাদিন এ খেলা সে খেলা দেখাতে বলে।

: পুত্র। মন খারাপ কর না। সময়ের কাছে আমরা সবাই হয়ে যাই দুষ্ট যবন দাস। তুমি দেখোনি পুত্র? মানুষের কাছে মানুষ বন্দী থাকে জনম জনম। বছর মাস দিন। পরিবার শেকল সমাজ শেকল পায়ে বিয়ে মাতৃত্ব ধর্ম অর্থ কড়ি মোহ ট্র্যাপে বন্দী হয় তোমার মতন। বন্দীত্ব স্বীকার না করলে মেরে ফেলত তোমায় মানুষের মতন।

- আচ্ছা মা। তুমি কী আসবে একদিন?

: কেনো পুত্র?

- জানো মা। সেলিম ভাই বাজন সুরে সুরে বলেছে,জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো। তুমি কী একটু আদর দেবেনা মাগো?

: কী বলেছে? - সুরে সুরে আরো বলেছে,আমরা মানুষের চেয়ে উত্তম। আমাদের সমাজে শ্রেণীশত্রু দালাল নেই। সামন্ত প্রভু নেই।

আজ শুক্রবার। তাপানুকুল ক্লাবে প্রবাসী মন্ত্রীপুত্র সুলতানের বিয়ে। তাপানুকুল পরিবেশে দরবার ব্যান্ড পার্টি ট্রাম্পেটার সেলিমের ডাক পড়েছে। ব্যান্ড মালিক শাহাবুদ্দিন নাগরী বকশিস লোভে দিনেরাতে বাজিয়ে যেতে বলেছেন। ক্লাবে দুপুরে বরযাত্রী ফিতে ধরা সময় হতে সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে একের পর এক সময় রাগের পরিবর্তন অভিমান ভাঙাতে গিয়ে এখন বাজে রাতের তিনটে। ঘরে না ফেরা বাবার অস্হির চিন্তায় মা মরা মেয়েটা দিশেহারা। এম পি মন্ত্রী ডাকসাইটে ব্যাংক মালিক কেতাদুরস্ত পত্রিকা সম্পাদক ঝোপ বুঝে কোপ মারা কিছু স্তাবক নেতা কবি শিল্পপতি ব্যবসায়ী স্পেশাল পাতে বাজনাদার সেলিম মিয়া বাজিয়ে চলেছেন। সেলিমের দমের বেলুনে খেলা করে চলেছে হিন্দী উর্দু বাংলা গানের বাহারি কথামালা। ট্রাম্পেট বাজনা তালে তালে অরজিন স্পেশাল এমেরাল্ড আইল হুইস্কি, রেড ওয়াইন হাতে ঘাড়ের রোয়া ফুলিয়ে সবাই গাইছে আরো চাই আরো চাই -হট সেক্সি ডিজে ইংরেজি হিন্দী গান।

ক্ষুধা তৃষ্ণা নিঃস্ব পুঁজিতে সেলিম মিয়ার মাথা ঘুরছে। সরে গেছে চিন্তার কালোমেঘ। স্পষ্ট হতে স্পষ্টতর হচ্ছে বাংলার আসমান জমিন পাহাড় নদী বঙ্গোপসাগর। পশু নাড়িভুঁড়ি পচা খাদ্যাভাবে মরে যাচ্ছে শারমেয়, শকুন, কাক। বিষাক্ত বুর্জোয়া করাল চিন্তা থাবা বসিয়ে দিয়েছে সবখানে। মাছ জলজ প্রাণী পদ্মা মেঘনা যমুনা বঙ্গোপসাগর ছেড়ে যাচ্ছে চিরতরে নিরাপদ দূরত্ব মেপে মানচিত্রের বাইরে। চিন্তার নৈর্ঋত অধিপতি এখন হাসছে।

ভোর হয়ে গেছে। ভেসে আসছে সুরেলা আযান মন্দিরের শঙ্খধ্বণি। হঠাৎ ধেয়ে আসছে বাঁজখাই সারমেয় চিৎকার, - বন্ধ কর! বন্ধ কর! ট্রাম্পেট। বেদুঈন বেয়াক্কেল নাস্তিক হারামি শোরগোল চিৎকারে থেমে গেছে ট্রাম্পেট। ফর্সা সেলিমের গাল হয়ে গেছে এক একটি জৌলুস ইসমে আজম। চোখগুলো চিরচেনা লজ্জা ঘৃণা অক্ষম আক্রোশ জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। ট্রাম্পেট চিকা পোস্টারে - সামন্ত শ্রেণী সংগ্রামের রক্ত চাই শিরোনামে ছেয়ে গেছে।

বেজে উঠে একটি চিরচেনা বাটন ফোনে

নির্ণীত শ্রেণিশত্রু চিহ্নিত স্পাই কণ্ঠস্বরঃ

'বাবা ঘরে আসো।'

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কবি, পুলিশ পরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ।

মেইল: [email protected]

  • সর্বশেষ
  • পঠিত