এক কিংবদন্তি বাঙালি স্থপতি এফ আর খান
মশিউর রহমান খান
প্রকাশ : ০৩ এপ্রিল ২০২২, ১৬:৫২ আপডেট : ০৩ এপ্রিল ২০২২, ১৮:৫১
মানুষের আগ্রহের বিষয়গুলি ছোটবেলা থেকেই বোঝা যায়। আমার স্কুলজীবনে পাঠ্যপুস্তকে এফ আর খান নামে একটা অধ্যায় ছিল। সেখানে পড়েছিলাম তিনি সে সময়কার সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং এর (Sears Tower) স্থপতি ছিলেন। মনে স্বপ্ন জাগতো আমি একদিন অনেক সুন্দর, অনেক উঁচু আকাশ ছোঁয়া যায় তেমন কিছু যদি করতে পারতাম। একটা বিষয় বুঝতে পারলাম স্থাপত্য নিয়ে পড়াশুনা করতে হবে। ভালোলাগা ও ভালোবাসা প্রকাশ করার এটিকে একটা মাধ্যমে হিসেবে বেছে নেওয়া যায়।
বিংশ শতাব্দীর সেরা স্ট্র্যাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার বা কাঠামো-প্রকৌশলীদের যদি তালিকা প্রস্তুত করা হয়, তাহলে তার পুরোভাগে থাকবে মরহুম ড. ফজলুর রহমান খানের নাম। বস্তুত বিংশ শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকে তিনি কাঠামো-কৌশলে, বিশেষ করে উঁচু ইমারত ডিজাইনে, যে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনেন তা বহু যুগ ধরে সারা বিশ্বকে প্রভাবিত করে আসছে।
ফজলুর রহমান খান ১৯২৯ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ খান বাহাদুর রহমান খান আর মাতার নাম ছিল বেগম খাদিজা খানম। স্কুলজীবনে পূর্ববাংলার বিভিন্ন স্কুলে পড়ে ১৯৪৪ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ও কলকাতা প্র্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার পর ১৯৪৬ সালে হাওড়া জেলার শিবপুরে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে প্রকৌশলে চূড়ান্ত পরীক্ষা দেওয়ার সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করা হয়। বিশেষ ব্যবস্থায় ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট) তাদের পরীক্ষা নেওয়া হয় এবং ওই বছরই ফজলুর রহমান খান প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন।
প্রকৌশলী হিসেবে ফজলুর রহমান খানের কর্মজীবন শুরু হয় ঢাকায়, ১৯৫০ সালে তিনি যখন তৎকালীন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পুরকৌশল বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫২ সালে তিনি ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আরবানা-শেম্পেইন-এ অবস্থিত ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য যান ও ১৯৫৩ সালে স্ট্র্যাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এএমএস এবং ১৯৫৫ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। একইসঙ্গে তিনি তত্ত্বীয় ও ফলিত বলবিদ্যায়ও এমএস ডিগ্রি লাভ করেন।
পরবর্তীতে আমেরিকার স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান স্কিডমোর-এর আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে এ কোম্পানির শিকাগো অফিসের পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন ৷ পাশাপাশি তিনি আমেরিকার ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি এর স্থাপত্য বিভাগে অধ্যাপক পদে অধিষ্ঠিত হন। সেখানে পরে তিনি এমিরিটাস প্রফেসর হয়েছিলেন। ড. এফ আর খান নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, লি হাই বিশ্ববিদ্যালয় ও সুইস ফেডারেল টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন ৷
ফজলুর রহমান খান সারা বিশ্বে খ্যাতিলাভ করেছেন পৃথিবীর উচ্চতম (১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত) ইমারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে অবস্থিত Sears Tower (পরবর্তীতে উইলিস টাওয়ার নামে পরিচিত) ডিজাইনার হিসেবে; কিন্তু তার সৃজনীশক্তির প্রথম নিদর্শন আমরা পাই সেতু ডিজাইনার হিসেবে। ১৯৫৫ সালে তিনি যখন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর খ্যাতনামা ফার্ম স্কিডমোর, ওয়িংস অ্যান্ড মেরিল-এ যোগ দেন কাঠামো-প্রকৌশলী হিসেবে, তখন তার ওপর দায়িত্ব পড়ে কয়েকটি সেতু ডিজাইনের। প্রিস্ট্রেস্ড বা প্রাকপীড়নকৃত কংক্রিট তখনো যুক্তরাষ্ট্রে সেতু নির্মাণে খুব একটা ব্যবহার করা হতো না। কিন্তু তিনি ১৯৫৭ সালে ডিজাইন করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ‘ঢালাইয়ের পর টানা দেওয়া প্রাকপীড়নকৃত কংক্রিট’ (post-tensioned prestressed concrete) রেলসেতু, আর এর ওপর ভিত্তি করেই রচনা করলেন তার প্রথম গবেষণা নিবন্ধ, যা ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয় আমেরিকান কংক্রিট ইনস্টিটিউটের জার্নালে।
ফজলুর রহমান খানের ডিজাইন করা সিয়ার্স টাওয়ার (বর্তমানে উইলিস টাওয়ার)
এরপর দেশে ফিরে এসে কিছুদিন ঢাকায় তিনি চাকরির চেষ্টা করেন এবং এখানে চাকরি না পেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে করাচি উন্নয়ন সংস্থায় নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলেন যে, দেশের অবস্থা তার প্রতিভার সুষ্ঠু বিকাশের অনুকূল নয়। তাই তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬০ সালে শিকাগোতে ফিরে গিয়ে তিনি আবার তার পুরনো ফার্মে যোগ দেন। এবার তার ওপর দায়িত্ব পড়ে উঁচু ইমারত ডিজাইনের, আর এ সময়ই তিনি উদ্ভাবন করেন ‘টিউবুলার’ বা ‘নলাকৃতি বিন্যাস’-এর ফর্মুলা।
যে কোনো ইমারতের কাঠামোর মূল দায়িত্ব হলো তার নিজের ওজন ছাড়াও ভবনের ভেতরের অন্যান্য জিনিসের ওজন ফাউন্ডেশন বা ভিতে পৌঁছে দেওয়া, আর ডিজাইনারদের খেয়াল রাখতে হয় নির্মাণসামগ্রী দিয়ে কাঠামোটি তৈরি করা হবে তার বহন ক্ষমতা যেন কোনো সময়েই অতিক্রম না করা হয়। তবে এছাড়াও ভূমিকম্প বা ঝরের সময় যে অতিরিক্ত পীড়ন সৃষ্টি হয় তা যাতে বহনসীমার ভেতর থাকে সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হয়।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে প্রচলিত রীতি ছিল উঁচু ইমারতের কাঠামোর জন্য কংক্রিট বা ইস্পাতের দৃঢ় কাঠামো ব্যবহার করা, যার প্রধান কাজ হলো নিজস্ব চলিষ্ণু খাড়া ভর vertical dead and live load, যেমন (দালানের ও ভেতরকার জিনিসপত্রের ওজন) ভিত-এ পৌঁছে দেওয়া। প্রায় ১৫ তলা পর্যন্ত ইমারতে এই পদ্ধতিতে কোনোরকম সমস্যা হয় না। কারণ দেখা যায় যে, বাতাসের চাপ বা ভূকম্পনের জন্য যে অতিরিক্ত পীড়ন (load) সৃষ্টি হয়, তার জন্য অতিরিক্ত কোনো কংক্রিট বা ইস্পাতের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু ১৫ তলার ওপরে উচ্চতা হলে এই অতিরিক্ত পীড়ন এত বেশি হয় যে, তার জন্য আরও কংক্রিট ও ইস্পাতের প্রয়োজন হয়, যার ফলে দৃঢ় কাঠামো দিয়ে তৈরি এসব দালানের খরচও অনেক বেড়ে যায়।
ড. এফ আর খানের টিউবুলার বিন্যাসের বিশেষত্ব হলো ইমারতের উচ্চতা যাই হোক না কেন (এমনকি একশ তলার ওপরও), বাতাসের চাপের জন্য সৃষ্ট পীড়ন বহন করার জন্য অতিরিক্ত কোনো খরচ হয় না, অর্থাৎ নিজস্ব ও চলিষ্ণু খাড়া ভরের জন্য যে কংক্রিট বা ইস্পাত দরকার, সেটাই এই অতিরিক্ত পীড়ন বহন করতে সক্ষম। টিউবুলার বিন্যাস কিন্তু টিউব বা নল দিয়ে তৈরি নয়। এই বিন্যাস গড়ে ওঠে প্রধানত কলাম ও বিমের সমন্বয়ে। এছাড়া দালানের ভেতরে সিঁড়ি ও লিফট গহ্বরের চারদিকে যে কংক্রিটে দেয়াল থাকে তাকেও টিউবের অংশ হিসেবে ধরা হয়। ইমারতের বাইরের দিকের কলামগুলো খুব কাছে কাছে বসিয়ে প্রতি তলায় বিম দিয়ে সংযুক্ত করলে এর প্রকৃতি টিউব বা ফাঁপা দন্ডের মতো হয়, যার ভূমিকম্প বা বায়ুচাপ থেকে সৃষ্ট পীড়ন বহনের ক্ষমতা বিম-কলাম-শিয়ার ওয়াল কাঠামোর তুলনায় অনেক বেশি। এছাড়া ভবনের ভেতরে কলাম না থাকায় অফিস অনেক খোলামেলাভাবে ডিজাইন করা সম্ভব।
একসময় বিশ্বের সবচেয়ে বড় খুচরা বিক্রেতা কোম্পানি ছিল সিয়ারস অ্যান্ড কোং। তাদের কর্মচারীর সংখ্যা ছিল তিন লাখ ৫০ হাজার। সব কর্মীর একটিমাত্র কার্যালয় বানানোর স্বপ্ন Sears কোম্পানির। এ স্বপ্নটি বাস্তবায়ন করেন আমাদের এফ আর খান। ১১০ তলা উঁচু একটি ভবনের নকশা তৈরি করেন তিনি। Sears Tower ( ১৬ জুন ২০০৯ থেকে পরিবর্তিত নাম উইলিস টাওয়ার) ছিল ১৯৭৩ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন। ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে উইলিস টাওয়ারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ভবনটি এর সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছায় ১৯৭৩ সালের ৩ মে। নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর এটি নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারকে ছাড়িয়ে বিশ্বের উচ্চতম ভবনে পরিণত হয়। ১১০তলা এই ভবনটির পূর্ব দিকের প্রবেশ পথ থেকে ছাদ পর্যন্ত উচ্চতা এক হাজার ৪৫০ ফুট সাত ইঞ্চি (৪৪২ মিটার)। ১৯৮২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে এর ছাদে দুটি টেলিভিশন এন্টেনা বসানো হয়। এগুলোসহ মোট উচ্চতা দাঁড়ায় এক হাজার ৭০৭ ফুট (৫২০ মিটার )। পশ্চিম দিকের এন্টেনাটিকে পরে ২০০০ সালের জুন ৫ তারিখে বাড়িয়ে দেওয়ায় ভবনের উচ্চতা দাঁড়ায় ১,৭২৯ ফুট (৫২৭ মিটার ), যা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের প্রথম টাওয়ারের এন্টেনাকে ছাড়িয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের অন্য যে কোনো বাণিজ্যিক ভবনের চেয়ে উইলিস টাওয়ারের মোট এলাকা বেশি। এখনো Sears Tower এর করিডোরের মূল ফটকে বাংলায় লেখা ‘স্বাগত’ এবং এফ আর খানের একটি ছবি। ফজলুর রহমান ছিলেন এই ভবনের স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার। উইলিস ভবন থেকে বের হওয়ার পথে স্মৃতিফলক চোখে পড়ে। স্মৃতিফলকে খচিত আছে এফ আর খানের ছবি। স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে কালের এক মহান স্থপতিকে।
উইলিস টাওয়ার
ড. খান বিভিন্ন ইমারতে বিভিন্ন ধরনের টিউব বিন্যাস ব্যবহার করেছেন। যেমন ১৯৬২ সালে শিকাগোর ৩৮ তলা অফিস ভবন ‘ব্রানসউইক বিল্ডিং’-এ তিনি ব্যবহার করেন নলের-মধ্যে-নল বিন্যাস (tube-in-tube system)। ১৯৬৪ সালে শিকাগোর ৪৩ তলা আবাসিক ভবন ‘চেস্টনাট ডিউইট অ্যাপার্টমেন্ট’-এ তিনি ব্যবহার করেন কাঠামোযুক্ত নলাকৃতি বিন্যাস (framed tube system)। ১৯৬৫ সালে শিকাগোর ১০০ তলা বহুবিধ ব্যবহার-উপযোগী ইমারত ‘জন হ্যানকক্ টাওয়ার’-এ ব্যবহার করেন আড়াআড়ি কাঠামোযুক্ত নলাকৃতি বিন্যাস (braced tube system)। ১৯৭০ সালে নিউ অরলিয়েন্সে ৫২ তলা ‘ওয়ান-শেল স্কোয়ার’-এ তিনি প্রথম ব্যবহার করেন ইস্পাত ও রিইনফোর্সড কংক্রিট সমন্বয়ে সমাহারকৃত নলাকৃতি বিন্যাস (composite tube system)। ১৯৭৩ সালে শিকাগোর ১১০ তলা অফিস ভবন Sears Tower-এ ব্যবহার করেন ইস্পাতের গুচ্ছ বাঁধা নলাকৃতি বিন্যাস (bundled tube system)।
এর প্রত্যেকটিরই বৈশিষ্ট্য হলো ইমারতের উচ্চতার জন্য কোনো অতিরিক্ত মূল্য দিতে হয়নি। এক কথায় ‘নলাকৃতি বিন্যাসের মাধ্যমে প্রকৌশলীদের জন্য তিনি এক নতুন ভাষার সৃষ্টি করে গেছেন’ আর সেই ‘ভাষা’ আজ সারা বিশ্বে ব্যবহৃত হচ্ছে। ড. খান শুধু নতুন বিন্যাসই উদ্ভাবন করেননি, প্রত্যেকটি বিন্যাস ডিজাইন করার নতুন পদ্ধতিও দিয়ে গেছেন। প্রত্যেকটি পদ্ধতির বিশেষত্ব হলো এগুলোতে কঠিন তাত্ত্বিক গণিতশাস্ত্রের প্রয়োগ নেই, বস্তুগত ধারণার সহজ প্রয়োগের ওপরই এগুলো এমনভাবে গড়ে উঠেছে যা একজন ডিজাইনার সহজেই বুঝতে পারেন। এসব ডিজাইন পদ্ধতির ব্যাখ্যা পাওয়া যায় সারা বিশ্বের নামকরা জার্নালগুলোতে প্রকাশিত তার নিবন্ধমালায়।
তার প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বিভিন্ন দুর্লভ সম্মান ও পুরস্কার লাভ করেছেন। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, লেহাই বিশ্ববিদ্যালয় ও সুইজারল্যান্ডের জুরিখ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিএসসি ডিগ্রি এবং ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং নিউজ রেকর্ড-এর ‘বছরের সেরা মানব’ সনদ। এছাড়া ১৯৭১ সালে আমেরিকান কংক্রিট ইনস্টিটিউট তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ গবেষণা নিবন্ধের জন্য ‘ওয়াটসন মেডেল’ প্রদান করে। বিলম্বে হলেও তার মাতৃভূমিতে প্রকৌশলীরা তার প্রতিভার স্বীকৃতি দিয়েছেন ১৯৮৯ সালে ‘বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন স্বর্ণপদক’ প্রদানের মাধ্যমে। আর বাংলাদেশ সরকার তাকে দিয়েছে ১৯৯৯ সালের ‘স্বাধীনতা পদক’; এ ছাড়া তার প্রতিকৃতি সংবলিত ডাকটিকিটও প্রকাশ করা হয়েছে।
৪ টাকা মূল্যমানের এই টিকিটটিতে রয়েছে ফজলুর রহমান খানের আবক্ষ চিত্র, আর পটভূমিতে রয়েছে সিয়ার্স টাওয়ারের ছবি। ১৯৯৮ সালে শিকাগো শহরের সিয়ার্স টাওয়ারের পাদদেশে অবস্থিত জ্যাকসন সড়ক পশ্চিম পার্শ্ব এবং ফ্রাঙ্কলিন সড়কের দক্ষিণ পার্শ্বের সংযোগস্থলটিকে নামকরণ করা হয় 'ফজলুর আর. খান ওয়ে'। তিনি নিজ জীবদ্দশায় অসংখ্য পদক ও সম্মাননা অর্জন করেছেন, জায়গা করে নিয়েছেন অসংখ্য ব্যক্তিহৃদয়ে। তেমনি মরণোত্তর পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা ও উপাধি।
উঁচু ইমারত ডিজাইন ছাড়াও অন্যান্য কাঠামো ডিজাইনে ড. খান তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় সৌর দূরবীণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ডিয়ারফিল্ডের এক কারখানা ভবনে তার দিয়ে ঝোলানো ২৮৮ ফুট স্প্যানযুক্ত ছাদ। জীবনের শেষ কয়েক বছর তার প্রধান দায়িত্ব ছিল জেদ্দায় বিমানবন্দর ও মক্কায় বাদশাহ আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিকল্পনা (অবশ্য তার মৃত্যুর পর বিদ্যালয়টির মাস্টারপ্ল্যান আর বাস্তবায়িত হয়নি)। জেদ্দা বিমানবন্দরের হজ টারমিনালে স্থানীয় পরিবেশ ও ঐতিহ্যর সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির অপূর্ব সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে তার ডিজাইন করা তাঁবু আকৃতির গড়ন। এই হজ টারমিনাল ডিজাইনের জন্য তিনি আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার লাভ করেন। ড. খানের স্থাপত্যকর্মের অন্যতম প্রধান মর্মবাণী ‘স্থাপত্যে থাকতে হবে কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিফলন’। জেদ্দায় এই প্রকল্পে কাজ করার সময় ১৯৮২ সালের ২৬ মার্চ তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর তার দেহ আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং শিকাগোতে তাকে সমাহিত করা হয়।
যদিও ড. খান জীবনের শুরুতে ছিলেন একজন স্ট্র্যাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার বা কাঠামো-প্রকৌশলী, কিন্তু ক্রমশ প্রকল্পের সার্বিক তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করতে শুরু করেন। তার ডিজাইন করা ভবনসমূহের স্থাপত্যে তার স্ট্র্যাকচারাল উদ্ভাবনী প্রতিভা এত পরিষ্কারভাবে পরিস্ফুটিত হয় যে অনেক সময় এসব ভবনের স্থপতি হিসেবেও তাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আর তাই ১৯৮২ সালে শিকাগো আর্কিটেকচারাল ক্লাব সদস্যরা তাকে সভাপতি নির্বাচিত করেন। শিকাগোর উন্নয়নে ড. ফজলুর রহমান খানের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ নগরীর কেন্দ্রস্থলে ৮ ফুট উঁচু ও ১১ ফুট দীর্ঘ একটি ভাস্কর্য স্থাপিত হয়েছিল। এতে ড. খানের প্রতিকৃতি ছাড়াও পশ্চাৎপটে আছে তার ডিজাইন করা কিছু উঁচু ভবনসহ শিকাগোর স্কাইলাইন। ব্রোঞ্জ ও স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে এটি তৈরি করেন স্পেনীয় শিল্পী কার্লোস ম্যাবিনাস। উত্তর আমেরিকার কোনো শহরে ড. খানই একমাত্র বাংলাদেশি (সম্ভবত একমাত্র এশীয়) যার প্রতি এমন বিরল সম্মান প্রদর্শিত হচ্ছে।
দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকা সত্ত্বেও মাতৃভূমির জন্য তার ভালোবাসা ছিল অগাধ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ আর্থিক সহায়তা ছাড়াও তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সপক্ষে জনমত সৃষ্টিতে নিরলস প্রচেষ্টা চালান এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাসী বাংলাদেশিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার অন্যতম প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করেন। ড. খানের ইচ্ছা ছিল দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমের সঙ্গে আরও সক্রিয়ভাবে জড়িত হওয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনগণের জন্য স্বল্প ব্যয়ে গৃহনির্মাণ সম্বন্ধে তিনি কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তার অকালমৃত্যুতে দেশবাসী সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো। বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে তিনি একজন স্থপতি-প্রকৌশলী হিসেবে যে বিরল আন্তর্জাতিক সম্মান পেয়েছেন তার জন্য জাতি গর্ববোধ করতে পারে।
ড. ফজলুর রহমান খান চলে গেলেও রয়ে গেছে তার কৃতিত্ব। তিনি বেঁচে আছেন তার কাজের মধ্যে, যা আজও সকলের কাছে দৃশ্যমান। তিনি চিরদিন সরবে উপস্থিত থাকবেন পৃথিবীর স্থাপত্যজগতের ইতিহাসে।
তথ্যসূত্র: বাংলা উইকিপিডিয়া ও জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী
লেখা: মশিউর রহমান খান, স্থপতি