ঘুরে আসুন সেন্টমার্টিন
জার্নাল ডেস্ক
প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৬:৫৬
সেন্টমার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত একটি প্রবাল দ্বীপ। এটি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থেকে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মায়ানমারের উপকূল হতে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত। প্রচুর নারিকেল পাওয়া যায় বলে স্থানীয়ভাবে একে নারিকেল জিঞ্জিরাও বলা হয়ে থাকে।
ইতিহাস : কবে প্রথম এই দ্বীপটিকে মানুষ শনাক্ত করেছিল তা জানা যায় নি। প্রথম কিছু আরব বণিক এই দ্বীপটির নামকরণ করেছিল জিঞ্জিরা। উল্লেখ্য এরা চট্টগ্রাম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যাতায়াতের সময় এই দ্বীপটিতে বিশ্রামের জন্য ব্যবহার করতো। কালক্রমে চট্টগ্রাম এবং তৎসংলগ্ন মানুষ এই দ্বীপটিকে জিঞ্জিরা নামেই চিনতো। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কিছু বাঙালি এবং রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ এই দ্বীপের বসতি স্থাপনের জন্য আসে। এরা ছিল মূলত মৎস্যজীবি। যতটুকু জানা যায়, প্রথম অধিবাসী হিসাবে বসতি স্থাপন করেছিল ১৩টি পরিবার। এরা বেছে নিয়েছিল এই দ্বীপের উত্তরাংশ। কালক্রমে এই দ্বীপটি বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত হয়। আগে থেকেই এই দ্বীপে কেয়া এবং ঝাউগাছ ছিল। সম্ভবত বাঙালি জেলেরা জলকষ্ঠ এবং ক্লান্তি দূরীকরণের অবলম্বন হিসাবে প্রচুর পরিমাণ নারকেল গাছ এই দ্বীপে রোপণ করেছিল। কালক্রমে পুরো দ্বীপটি একসময় 'নারকেল গাছ প্রধান' দ্বীপে পরিণত হয়। এই সূত্রে স্থানীয় অধিবাসীরা এই দ্বীপের উত্তরাংশকে নারিকেল জিঞ্জিরা নামে অভিহিত করা শুরু করে। এরপর ধীরে ধীরে এই অঞ্চলের বাইরের মানুষের কাছে, দ্বীপটি সেন্ট মার্টিন নামেই পরিচিত লাভ করে।
ভূপ্রকৃতি: সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপটির ভূপ্রকৃতি প্রধানত সমতল। তবে কিছু কিছু বালিয়াড়ি দেখা যায়। এ দ্বীপটির প্রধান গঠন উপাদান হলো চুনাপাথর। দ্বীপটির উত্তর পাড়া এবং দক্ষিণ পাড়া দু’জায়গারই প্রায় মাঝখানে জলাভূমি আছে। এগুলো মিঠা পানি সমৃদ্ধ এবং ফসল উৎপাদনে সহায়ক। দ্বীপটিতে কিছু কৃষি উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগন্য।
জীববৈচিত্র:সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপে প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১শ ৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১শ ৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১শ ৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, ২শ ৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ১শ ২০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। স্থানীয়ভাবে পেজালা নামে পরিচিত Sea weeds বা অ্যালগি (Algae) এক ধরণের সামুদ্রিক শৈবাল সেন্ট মার্টিন্সে প্রচুর পাওয়া যায়। এগুলো বিভিন্ন প্রজাতির হয়ে থাকে তবে লাল অ্যালগি (Red Algae) বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জনপ্রিয়। এছাড়াও রয়েছে ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী।[১] অমেরুদন্ডী প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে স্পঞ্জ, শিল কাঁকড়া, সন্যাসী শিল কাঁকড়া,লবস্টার ইত্যাদি। মাছের মধ্যে রয়েছে পরী মাছ, প্রজাপতি মাছ, বোল করাল,রাঙ্গা কই, সুঁই মাছ, লাল মাছ,উড়ুক্কু মাছ ইত্যাদি। [১] সামুদ্রিক কচ্ছপ সবুজ সাগর কাছিম এবং জলপাইরঙা সাগর কাছিম প্রজাতির ডিম পাড়ার স্থান হিসেবে জায়গাটি খ্যাত।
পর্যটন: দ্বীপটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। পর্যটন মৌসুমে এখানে প্রতিদিন ৫টি লঞ্চ বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড হতে আসা যাওয়া করে। সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপে বর্তমানে বেশ কয়েকটি ভালো আবাসিক হোটেল রয়েছে। একটি সরকারি ডাকবাংলো আছে। সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাল।
সেন্টমার্টিন কেন যাবেন:যদি বলেন সমুদ্র দেখতে তাহলে আপনার জন্য পরামর্শ হল সমুদ্র দেখার জন্য কষ্ট করে সেন্টমার্টিন যাবার দরকার নেই। কক্সবাজার ,কুয়াকাটাতেও তো সমুদ্র দেখতে পারেন? সেন্টমারটিন মূলত যাওয়া উচিৎ রহস্যের সন্ধানে। নির্জনতার রহস্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রহস্য আর সাগর তলের বিস্ময়কর রহস্য। সৃষ্টিকর্তা এখানকার প্রকৃতিকে দু’হাত ভরে দান করেছেন।
কিভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে সরাসরি শ্যামলী, হানিফ, রিলেক্স, তুবা লাইন(নন এসি) এবং সেন্ট মার্টিন সার্ভিস, বাগদাদ এক্সপ্রেস, গ্রীন লাইন (এসি) সহ বেশ কিছু বাস টেকনাফ যায়। নন এসি বাসের ভাড়া ৯০০ টাকা আর বেশিরভাগ এসি বাসের ভাড়া ১৫৫০ টাকা। দমদমিয়া ঘাট থেকে বেশ কয়েকটি শিপ ছাড়ে সেন্ট মার্টিনের উদ্দেশ্যে সকাল ৯ঃ৩০ মিনিটে। যা দ্বীপে পৌছায় ১২ টার মধ্যে। এগুলো ফিরে আসে বিকেল ৩ টার দিকে সেন্ট মার্টিন থেকে। শিপ ও ক্লাস ভেদে এগুলোর ভাড়া ৫৫০ থেকে ১৭০০ টাকা পর্যন্ত। তবে অফ সিজনে (এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) শিপগুলো চলে না, এই সময়টাতে সেন্ট মার্টিন যাওয়ার একমাত্র উপায় হল ট্রলার।
কক্সবাজার থেকে গেলে প্যাকেজ নিয়ে যাওয়াই ভালো। কক্সবাজারে যে হোটেলে থাকবেন, তাদের কাছে বললে তারা ব্যবস্থা করে দিবে। তবে তাদের কাছে শুধু ট্রান্সপোর্ট এর সুবিধা ও আলাদা করে নেয়া যায়। এর সুবিধা হল খুব ভোরে উঠে টেকনাফ যাওয়ার জন্য বা শিপের টিকেটের জন্য আলাদা করে দৌড় ঝাঁপ করতে হবে না। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ, শিপের রিটার্ন টিকেট(সেন্ট মার্টিন যাওয়া এবং আসা) এবং আবার টেকনাফ থেকে কক্সবাজার নিয়ে আসা সব মিলিয়ে খরচ হয় ১০০০-২০০০ টাকা (শিপের ক্লাস ভেদে খরচ বাড়ে-কমে)।
কি খাবেন: এই দ্বীপের সবচেয়ে বিখ্যাত জিনিস হল ডাব। এই দ্বীপের নাম নারিকেল জিঞ্জিরা এমনি এমনি হয়নি। এখানকার ডাবের পানি যেমন মিষ্টি তেমনি সুস্বাদু। সেন্ট মারটিনে গেলে ডাবের পানি মিস করা ঠিক হবে না। যারা মাছ খান না আমার মতে তাদের সেন্ট মার্টিন যাওয়ার অধিকারই নেই। কারন কোরাল,সুন্দরী পোয়া,ইলিশ, রূপচাঁদা,লবস্টার,কালাচাঁদার স্বাদ এক কথায় অসাধারণ। আর একটা জিনিস অবশ্য খেয়ে দেখতে পারেন। সেটা হল কুরা (স্থানীয় ভাসায় দেশী মুরগিকে বলা হয় কুরা)। শুঁটকি মাছ খাওয়ার ক্ষেত্রে লইট্টা, ছুড়ি, রূপচাঁদা, কাচকি ট্রাই করতে পারেন। তবে মনে রাখবেন বেশির ভাগ শুঁটকি কিন্তু আসে কক্সবাজার ও চট্ট্রগ্রাম থেকে। যারা ইলিশ খুব বেশি পছন্দ করেন তারা জেনে রাখুন সমুদ্রের ইলিশ নদীর ইলিশের মত টেস্টি নয়।
আরেকটি কথা,যারা জানুয়ারী বা ফেব্রুয়ারীতে সেন্ট মারটিন যাবেন তারা অবশ্যই তরমুজ মিস করবেন না। দেখতে খুব একটা লাল না হলেও খেতে কিন্তু বেশ।
ভ্রমণের জন্য বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর স্থান সেন্টমার্টিন। পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে সবসময়ই থাকে ‘বঙ্গোপসাগরের টিপ’ বলে খ্যাত এ দ্বীপ। তবে রাত যাপনের জন্য দ্বীপে হোটেল বা রিসোর্ট ঠিক করতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয় অনেককেই। তাদের সুবিধার্থে কয়েকটি হোটেল ও রিসোর্টের পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে....
ব্লু মেরিন:জেটি থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত হোটেলটির অবকাঠামো চমৎকার। তিন তলা বিশিষ্ট এ হোটেলে ৩৪টি বিলাসবহুল রুমসহ নিজস্ব রেস্টুরেন্ট রয়েছে। বাজারের কাছে বলে এর আশপাশে মানুষের সমাগম খুব বেশি। এছাড়া রুম থেকে সরাসরি বিচ দেখা যায় না। রুম ভাড়া ২,৫০০-৩,৫০০ টাকা। যোগাযোগ: ০১৭১৩৩৯৯০০০ (ঢাকা), ০১৭১৩৩৯৯২৫০ (সেন্টমার্টিন)।
সী ভিউ:জেটি থেকে ৭ মিনিট হাঁটতে হয়। এখানে নিজস্ব রেস্টুরেন্টসহ ১৬টি রুম ও ৪টি তাবু রয়েছে। এর অধিকাংশ রুম থেকে সমুদ্র দেখা যায়। এছাড়া ফ্রি ওয়াইফাই ও স্পোর্টসের সুবিধা রয়েছে। তবে নিজস্ব রেস্টুরেন্টটি প্রায় ত্রিশ মিটার দূরে অবস্থিত। রুমের ভাড়া ১,২০০-৩,০০০ টাকা। যোগাযোগ: ০১৮৪০৪৭৭৭০৭ (ঢাকা), ০১৮৪০৪৭৭৯৫৬ (সেন্টমার্টিন)।
নীল দিগন্ত:দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত রিসোর্টটির রুমের সংখ্যা ৩৮টি। রেস্টুরেন্টও রয়েছে এখানে। এর সব রুমই টিনশেড। রুমভাড়া ২,০০০-৪,৫০০ টাকা। তবে জেটি থেকে দূরে হওয়ায় ভ্যান ভাড়া পরে ২শ’ টাকা। এছাড়া রুম থেকে বিচ দেখারও সুযোগ নেই। অন্যান্য সবকিছু ঠিকঠাক আছে। যোগাযোগ: ০১৭৩০০৫১০০৫, ০১৭৩০০৫১০০৬, ০১৭৩০০৫১০০৭।
লাবিবা বিলাস:রিসোর্টের ৪৩টি রুম, একটি রেস্টুরেন্ট ও একটি ছোট্ট সেমিনার রুম রয়েছে। এর অবস্থান নর্থ বিচে। শিপঘাট থেকে যেতে একটু বেশি সময় লাগে, তবে হাঁটাপথে ১৫-২০ মিনিট। রুম ভাড়া ১,৬০০-৪,০০০ টাকা। রিসোর্টে সবরকম আধুনিক সুবিধার পাশাপাশি খেলাধুলার ব্যবস্থা রয়েছে। যোগাযোগ: ০১৭৪৪১৩৬১৪৫ (ঢাকা), ০১৮৩৪২৬৭৯২২ (সেন্টমার্টিন)।
প্রাসাদ প্যারাডাইজ:এর অবস্থান ব্লু মেরিনের কিছুটা উত্তরে। এখানে মোট ১৬টি কক্ষ। হোটেলের সাথে রেস্টুরেন্টও আছে। বিচ থেকে একটু দূরে বলে অল্প কয়েকটি রুম থেকে সমুদ্রের কিছুটা দেখা যায়। প্রতি রুমের ভাড়া ২,০০০-৪,০০০ টাকা। যোগাযোগ: ০১৫৫৬৩৪৭৭১১।
সী ইন:সেন্টমার্টিন বাজারের মূল রাস্তা ধরে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই এর অবস্থান। এতে ২৬টি কক্ষ রয়েছে। নিজস্ব রেস্টুরেন্ট নেই, তবে আশেপাশে রয়েছে। প্রতি রুমের ভাড়া ২,০০০-৩,৫০০ টাকা। এখান থেকে সমুদ্র দেখার কোনো উপায় নেই। নির্জনতা উপভোগের সুযোগও কম। যোগাযোগ: ০১৭২২১০৯৬৭০, ০১৭৩৫৫৮১২৫১, ০১৭৭৫০১১২০৮।
সীমানা পেরিয়ে:এর অবস্থান ওয়েস্ট বিচে, ভ্যানে করে যেতে হয়। এতে ১৪টি রুম ও একটি রেস্টুরেন্ট আছে। বিচের কাছাকাছি বলে কয়েকটি রুম থেকে সমুদ্র দেখা যায়। এর ভাড়া ১,৫০০-২,৫০০ টাকা। যোগাযোগ: ০১৯১১১২১২৯২, ০১৮১৯০১৮০২৭।
কোরাল ভিউ:রিসোর্টটি নৌবাহিনী পরিচালনা করে। ইস্ট বিচে এর অবস্থান। জেটি থেকে দূরে বলে ভ্যান বা বোট নিয়ে যেতে হয়। এর আয়তন অনেক বড়ো এবং রুম থেকে সমুদ্র দেখা যায়। রিসোর্টের সামনে একটি সবুজ মাঠ রয়েছে। একে হেলিপ্যাড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আছে নিজস্ব রেস্টুরেন্ট। রুমপ্রতি ভাড়া ২,৫০০-৬,০০০ টাকা। যোগাযোগ: ০১৯৮০০০৪৭৭৭, ০১৯৮০০০৪৭৭৮।
প্রিন্স হ্যাভেন:নর্থ বিচের পাশে এর অবস্থান। এখান থেকে সমুদ্র বেশ ভালো দেখা যায়। রিসোর্টে ২৪টি কক্ষ ও রেস্টুরেন্ট আছে। কক্ষগুলোর ভাড়া ২,০০০-৪,০০০ টাকা। যোগাযোগ: ০১৮৩৩৩৬০৩৩৩।
সী প্রবাল:নর্থ বিচের রিসোর্টটি সী ভিউ থেকে সামান্য দূরে। এখানে ১৬টি রুম ও একটি রেস্টুরেন্ট আছে। এর চারটি রুম ছাড়া অন্য রুম থেকে সমুদ্র দেখার উপায় নেই। প্রতিটি রুমের ভাড়া ১,৫০০-২,৫০০ টাকা। যোগাযোগ: ০১৮১৬৪৬৭৪০৬, ০১৭৬১২০০৬৮৯।
বি.দ্র: রুম ভাড়ার ক্ষেত্রেও ভালোভাবে দরদাম করা উচিত। তবে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত রুম ভাড়া বেশি থাকে।
/এনএ্ইচ/