ঢাকা, রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১ আপডেট : ২০ মিনিট আগে
শিরোনাম

রহস্যময় আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি

  ইতিহাস-ঐতিহ্য ডেস্ক

প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:৫৬  
আপডেট :
 ১৯ জানুয়ারি ২০২১, ১৭:১২

রহস্যময় আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি
প্রতীকী ছবি

পৃথিবীর যতোগুলো রহস্য ঘেরা স্থান আছে তার মধ্যে সাহারা মরুভূমি অন্য সবার চেয়ে অনেক গুণ এগিয়ে। সাহারা মরুভূমি কালের স্রোতে বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। বর্তমান সাহারা যেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম স্থান; কয়েক কোটি বছর আগে তা ছিলো টেথিস সাগর! কিংবা বালুর রাজ্য খ্যাত সাহারা একসময় ছিলো সবুজ, উর্বর আর জনবসতিপূর্ণ! আফ্রিকার দক্ষিণ অংশ থেকে আদি মানব এখান দিয়েই রওনা হয়েছিলো ইউরোপের উদ্দেশ্যে। যুগ যুগ ধরে গবেষণা চলতে থাকলেও রহস্যের জট পুরোপুরি খুলেনি। অবাক করা সব তথ্য দিয়ে গোলক ধাঁধায় ফেলেছে মানুষকে। বাংলাদেশ জার্নালের এই আয়োজনে জানাবো সাহারা মরুভূমির ইতিবৃত্ত!

আফ্রিকার ১২টি দেশের সীমানাজুড়ে সাহারা মরুভূমি। উত্তর আফ্রিকার একটি বড় অংশ জুড়ে আধিপত্য। মিশর, মরক্কো, আলজেরিয়া, লিবিয়া, নাইজার, মালি, পশ্চিম সাহারা, তিউনিসিয়া, মৌরিতানিয়া, ইরিত্রিয়া, সুদানের অংশে রয়েছে এই মরুভূমি। উত্তর আফ্রিকার ৩১ শতাংশ জুড়ে সাহারা মরুভূমি অবস্থিত। এর মোট আয়তন ৩৬ লক্ষ বর্গমাইল। ২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয় এমন এলাকাকে যুক্ত করলে সাহারার আয়তন বেড়ে দাঁড়াবে ৪২ লাখ বর্গমাইলে। যা প্রায় যুক্তরাষ্ট্রের আয়তনের সমান!

গোটা আফ্রিকা মহাদেশ পৃথিবীর একটা টেকটনিক প্লেটের উপর অবস্থিত। বহুকাল আগে আফ্রিকা ও ইউরোপের মাঝে টেথিস সাগর ছিল। ধারণা করা হয় ৪ কোটি বছর আগে টেকটনিক প্লেটের গতির ফলে টেথিস সাগর উত্তরের দিকে সরে আসে এবং আফ্রিকা আর ইউরোপ একসাথে মিলে যায়। ফলশ্রুতিতে আফ্রিকার উত্তর অংশ সংকুচিত হয় এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উপরে উঠে যায়। এরপর এই এলাকা ধীরে ধীরে পানিশূন্য হয়ে যায়।

জার্মানির এক গবেষকের ৪০ বছরের গবেষণা থেকে উঠে আসে, ৪ থেকে ১২ হাজার বছর আগেও সাহারা ছিলো সবুজ ও উর্বর। প্রতি ২০ হাজার বছর পর পর সাহারা মরুভূমি জলাভূমি থেকে তৃণভূমিতে পরিণত হয়। প্রতি ২০ হাজার বছর পর পর পৃথিবী উত্তর দিকে সামান্য কাত হয়। এর ফলে পৃথিবীর মৌসুমি বায়ুর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে সাহারা মরুভূমিতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ফলে এই অঞ্চলে প্রচুর গাছপালা জন্মায় এবং মনুষ্যকূলের অনুকূলে চলে আসে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ১৫ বছর পর সাহারা আবার সবুজ হয়ে উঠবে।

সাহারা মরুভূমি যে পূর্বে সাগর ছিলো তার প্রমাণ মিলে মিশরের রাজধানী কায়রো থেকে দেড়শো কিলোমিটার দূরে। সাহারা মরুভূমির ওয়াদি আল হিতান বা তিমির উপত্যকা নামক একটি স্থানে প্রায় ৩৬ লক্ষ বছর আগে বিলুপ্ত ডোরাডান প্রজাতির তিমির ফসিল খুঁজে পাওয়া যায়। এখন পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জীবাশ্ম পাওয়া গেছে ওয়াদি আল হিতানে।

বালুর রাজ্য সাহারা মরুভূমিকে পাঁচটি অঞ্চলে ভাগ করা যায়। পশ্চিম সাহারা, এয়ার পর্বতমালা, তিবেস্তি পর্বতমালা, লিবিয়ান মরুভূমি ও তিনেরি মরুভূমি। পাথুরে মালভূমি ও বালির সমুদ্র নিয়ে গঠিত সাহারা। এখানে একবার বালুর ঝড় শুরু হলে টানা চারদিন পর্যন্ত চলতে পারে। মাঝে মাঝে বালু ঝড়ের কারণে বালু রূপ নেয় সুউচ্চ শৃঙ্গে! যার বেশির ভাগের উচ্চতা ১৮০ মিটারের বেশি হয়ে থাকে!

সাহারা মরুভূমি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বালির স্তুপ। এখানকার বালি দিয়ে গোটা পৃথিবীকে ৮ ইঞ্চি পুরু করে ঢেকে ফেলা যাবে! হাল্কা বৃষ্টিপাত আর বাতাসের সংমিশ্রণে সাহারার বালু বিভিন্ন রূপ ধারণ করে। যার মধ্যে দেখা মিলে বালিয়াড়ি, পাথুরে মালভূমি, শুষ্ক উপত্যকা কিংবা নুড়ি পাথরের। তবে বালুর রাজ্য হলেও সাহারায় বেশ কয়েকটি অংশে তৃণভূমি আর পর্বত রয়েছে। ছোটবড় বেশ কটি হ্রদ আর নদীর অস্তিত্বও রয়েছে সাহারায়।

পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম স্থান বলা হয় সাহারা মরুভূমিকে। কারণ পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের তুলনায় সাহারায় সূর্যের স্থায়িত্ব অনেক বেশি। মরুভূমির বেশিরভাগ অংশ ৮২ শতাংশের অধিক সূর্যরশ্মি পেয়ে থাকে। আর সাহারার পূর্বাঞ্চলে বছরে প্রায় ৯১ শতাংশ বা ৪ হাজার ঘণ্টা সূর্যরশ্মির মধ্যে থাকে।

এছাড়া প্রয়োজনের তুলনায় কম গাছপালা, স্বল্প বৃষ্টিপাতের কারণে এখানে উষ্ণতার পরিমাণ বেশি। গ্রীষ্মকালে ৩৮-৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রার অসহনীয় হয়ে পরে সাহারা। তবে গা পুড়ে যাওয়ার মতো তাপমাত্রায়ও পৌঁছেছিলো। আলজেরিয়ান মরুভূমির বোউ বারনোস শহরে ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিলো। বালুর তাপমাত্রা পরখ করতে গিয়ে চক্ষু ছানাবড়া। সুদানে বালুর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিলো ৮৩.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস বা ১৮২.৩ ফারেনহাইট!

উষ্ণতা, খড়খড়ে মরুভূমি বলে এখানে প্রাণের স্পন্দন নেই ধারণা করলে ভুল হবে। ভৌগলিক আর বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানকার জীবজগৎও কিছুটা বিচিত্র। সাহারা মরুভূমিতে উদ্ভিদ জগতের প্রায় ২ হাজার ৮০০ প্রজাতির বৃক্ষ রয়েছে। এখানকার এক চতুর্থাংশ উদ্ভিদ স্থানীয়। যা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায়না। খেজুর, সাকুলেন্ট, আকাসিয়াসহ অনেক গাছ রয়েছে সাহারায়। আবহাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে এদের আকৃতিও অন্যান্য গাছের চেয়ে ভিন্ন। বালুঝড় কিংবা তীব্র বাতাসের হাত থেকে রক্ষা পেতে গাছের আকার ছোট। শুষ্ক মৌসুমে পানি ধরে রাখার জন্য স্থুলকায় কাণ্ড এবং সহজে পানি সন্ধান পেতে মাটির নীচে রয়েছে প্রশস্ত মূল।

বৃক্ষরাজির পাশাপাশি সাহারা মরুভূমির প্রাণীকূলও বেশ সমৃদ্ধ। এডেক্স নামক এক ধরণের হরিণের বাস সাহারা মরুভূমিতে। পানি ছাড়া প্রায় এক বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে এডেক্স। দরকাস গ্যাজেল নামক হরিণও দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে। যেটিরও বাস এই সাহারায়। এছাড়া কয়েক প্রজাতির শিয়ালের বাস সাহারায়। মালি, নাইজার, তোগো, আলজেরিয়া অঞ্চলে সাহারান চিতা বাস করে।

বিভিন্ন সরীসৃপ প্রজাতির প্রাণীর দেখা মিলে এখানে। মৌরিতানিয়া এবং এনেদি মালভূমিতে ছোট প্রজাতির কুমির বাস করে। অত্যন্ত বিপদজনক ডেথস্টার বিছার বাসও এখানে। ১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা এই বিছার বিষে অধিক পরিমাণে এজিটক্সিন ও সাইলাটক্সিন রয়েছে। পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষকে মেরে ফেলতে ডেথস্টারের এক দংশনই যথেষ্ট!

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাহারার অংশ বেড়ে চলেছে। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় পাওয়া গেছে, বিগত ১০০ বছরে সাহারা ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে বৃদ্ধি পেয়েছে খরা। আর বৃষ্টিপাতের হার কমে যাওয়ায় সাহারা মরুভূমির আয়তন বেড়ে চলেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে যুক্ত হয়েছে মানুষের বেখেয়ালি আচরণ। এমন চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে সাহারার ঘনত্ব বৃদ্ধি পাবে। মানুষের জন্য যা হুমকিস্বরূপ!

বাংলাদেশ জার্নাল/এনআর/এইচকে

  • সর্বশেষ
  • পঠিত