স্কুলের লাজুক ছেলে থেকে প্রখ্যাত শিল্পপতি
জার্নাল ডেস্ক
প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২৪, ১৩:১৬ আপডেট : ১০ অক্টোবর ২০২৪, ১৩:২২
ভারতের অন্যতম শীর্ষ ধনী রতন টাটা মারা গেছেন। স্থানীয় সময় বুধবার (৯ অক্টোবর) রাতে ভারতের মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে না ফেরার দেশে চলে যান তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। তাঁর সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হল দেশের শিল্পক্ষেত্রের একটি অধ্যায়। নিজের আয়ের ৬৫ শতাংশ মানুষের কল্যাণে দান করে যাওয়া রতন টাটার মৃত্যুতে ভারতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
রতন টাটাকে চেনেন না পৃথিবীতে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। জীবনে তিনি শুধুমাত্র একজন সফল শিল্প উদ্যোক্তাই ছিলেন না। ছিলেন মানবতার ফেরিওয়ালা। মানব সেবায় তার বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে ভারতে। রতন টাটার ব্যক্তিত্ব, মানবিকতা আর পাঁচজন ব্যবসায়ীর থেকে উঁচু স্থানে পৌঁছে দিয়েছে তাকে। একজন সফল ও বিশ্বের প্রথম সারির ব্যবসায়ী হওয়া সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ তাকে মানুষ হিসেবেই দেখেছে। জনকল্যাণে তার বহু প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা রয়েছে ভারতে।
দুই দশকের বেশি সময় ধরে রতন টাটার নেতৃত্ব দেয়া টাটা গ্রুপের শিল্পে ‘লবণ থেকে সফটওয়্যার’সবই রয়েছে। বর্তমানে ইস্পাত থেকে শুরু করে সফটওয়্যার, উড়োজাহাজ থেকে লবণের মতো খাতে তাদের ব্যবসা রয়েছে।
এই গ্রুপের রয়েছে শতাধিক কোম্পানি। কর্মীও সাড়ে ৬ লাখের বেশি। শিল্পগোষ্ঠীটির বার্ষিক রাজস্ব আয় ১০ হাজার কোটি (১০০ বিলিয়ন) ডলারের বেশি। ১৫৫ বছরের পুরোনো টাটা শিল্পগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জামশেদজি টাটা। ভারতের শিল্পের পথপ্রদর্শক হিসেবে গণ্য করা হয় তাঁকে।
রতন নেভাল টাটা ১৯৩৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর ভারতের মুম্বাইতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা ছিলেন পারসি পরিবারের। তাঁর পিতার নাম নেভাল টাটা, মায়ের নাম সোনি টাটা।
রতন টাটার বাবা নাভাল টাটা পরিবারে এসেছিলেন দত্তক সন্তান হিসেবে। নাভালের প্রথম স্ত্রী সোনির ঘরে জন্ম হয় রতন টাটার। রতন টাটার বয়স যখন ১০ বছর, তখন মা–বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এরপর থেকে রতন টাটা ও তাঁর ছোট ভাই জিমি টাটা বড় হন তাঁর দাদি নওয়াজবাই টাটার কাছে। এই সময়ের কথা খুব একটা প্রকাশ্যে বলতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন না তিনি।
টাটা কোম্পানির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, স্কুলজীবনে মুম্বাইয়ের ক্যাম্পিয়ন ও ক্যাথেড্রাল অ্যান্ড জন কনন স্কুলে পড়েছেন রতন টাটা। স্কুলে তিনি বেশ লাজুক ছিলেন। মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ভয় পেতেন।
পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে স্থাপত্যবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন রতন টাটা। সাত বছর যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সময় গাড়ি ও উড়োজাহাজ চালানো শেখেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রকে ভালো লাগার দরুন সেখানে স্থায়ী হতে চাইলেও অসুস্থ দাদি লেডি নাভাজ বাইয়ের জন্য ১৯৬২ সালে ভারতে ফিরে আসেন তিনি।
ভারতে ফিরে আসলে এই সময়ে জে আর ডি টাটা তাঁকে টাটা শিল্পগোষ্ঠীতে যোগ দিতে বলেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, জে আর ডি টাটা তাঁর কাছে বাবা ও ভাইয়ের মতো।
অর্ধশতক ধরে টাটা গ্রুপকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জে আর ডি টাটা। ১৯৯১ সালে তিনি রতন টাটাকে নিজের উত্তরসূরি হিসেবে নিয়োগ দেন। সে সময়ে অনেকেই জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে এই দায়িত্বে আসার যোগ্যতা থাকলেও তাদের বাদ দিয়ে রতন টাটাকে উত্তরসূরি করায় সে সময় কিছুটা সমালোচনাও হয়েছিল। তবে জে আর ডি টাটার সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল তা পরবর্তীতে কাজের মাধ্যমেই প্রমাণ করে দেখিয়েছেন রতন টাটা।
রতন টাটার নেতৃত্বকালীন সময়ে সফলতার উচ্চ শিখরে উঠে টাটা গ্রুপ। তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠানটি অ্যাংলো-ডাচ ইস্পাত প্রস্তুতকারী কোম্পানি ‘কোরাস’ ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিখ্যাত গাড়ি প্রস্তুতকারী কোম্পানি জাগুয়ার ও ল্যান্ড রোভারের অধিগ্রহণ করে। এ দুটি সিদ্ধান্তের জন্য তিনি বেশ প্রশংসিত হন। ২০০০ সালে আরেক সফলতার মুখ দেখে টাটা গ্রুপ। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চা কোম্পানি টেটলি নিয়ে আসে টাটা।
তবে সাফল্যের সঙ্গে ব্যর্থতাও ছিল। টেলিকম খাত ব্যর্থ হওয়ায় টাটা গ্রুপ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে। ২০০৯ সালে রতন টাটার কম দামে ন্যানো গাড়ি প্রস্তুত করার প্রকল্পটিও ব্যর্থ হয়।
দানশীলতা, নম্রতা, পশুপাখি, বিশেষ করে কুকুরের প্রতি ভালোবাসা, ধীরস্থিরভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সুখ্যাতি ছিল রতন টাটার। খুবই সাধারণ জীবনযাপন করতে পছন্দ করতেন তিনি। আরাম আয়েশি জীবনযাপন করতে দেখা যায়নি তাকে। এছাড়া অনেক কল্যাণকর ও জনহিতকর কাজ করলেও কখনই প্রচার প্রচারণায় বিশ্বাসী ছিলেন না তিনি। বরং নিরবে নিভৃতে জনগণের সেবা করাই ছিল তার উদ্দেশ্য।
টাটা ট্রাস্টের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং গ্রামীণ উন্নয়নের মতো অসংখ্য জনহিতকর উদ্যোগের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। তবে তার জীবনের অর্জনের জন্য প্রায়শই তার চারপাশের মানুষের অবদান তুলে ধরতেন রতন টাটা। দেশটির অন্যতম বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান টাটা গ্রুপের ইমেরিটাস চেয়ারম্যান ছিলেন রতন টাটা।
সূত্র: ভারতীয় গণমাধ্যম
বাংলাদেশ জার্নাল/ওএফ