চার বছরে ট্রাম্পের যেসব অঘটন!
নাকিব ইয়াহহিয়া
প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২০, ১৩:১০ আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০২০, ১৩:২০
গোটা বিশ্বের জন্যই অভিনব ছিলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরের মেয়াদকাল। তার সেই মেয়াদকালে অঘটনগুলো কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় না।
বিরোধীপক্ষ বা ব্যক্তিকে অবিশ্বাস্যভাবে তিনি কাছে টেনেছেন। আবার নিজ মিত্র কিংবা আপনজনদের দূরে ঠেলে দিয়েছেন বিস্ময়করভাবে।
ব্যক্তিগত কিংবা পারিবারিক জীবনে চরম বিতর্কিত হয়ে ওঠা ট্রাম্পের বিরূপ আচরণ আর আপনজনদের প্রতি হিংসাত্মক মনোভাব প্রকাশ্যে এসেছে বহুবার। কখনও সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে কখনও বা বই আকারে। যার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত, টু মাচ অ্যান্ড নেভার এনাফ: হাউ মাই ফ্যামিলি ক্রিয়েটেড দি ওয়ার্ল্ডস মোস্ট ডেঞ্জারাস ম্যান বইটি। যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, হয় খুব বেশি, নয় তো খুব কম: আমার পরিবার থেকে যেভাবে তৈরি হলো বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক মানুষ ।
আপন চাচার কিচ্ছা কাহিনিতে ভরপুর এই বইটি লিখেছেন ট্রাম্প পরিবারের সদস্য আপন ভাতিজি মেরি ট্রাম্প। এতে ট্রাম্পের সঙ্গে পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের অস্বাভাবিক সম্পর্কের বিষয় যেমন এসেছে, তেমনই এসেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার ভূমিকা। বইয়ে মেরি দাবি করেছেন, তার চাচা ট্রাম্প বিশ্বস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে উঠেছেন। সেই সঙ্গে পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে ট্রাম্প যে স্বার্থপরতার পরিচয় দিয়েছেন তার বিস্তারিতও রয়েছে বইটিতে।
শুধু মেরিই নন, আন্তজার্তিক রাজনীতির বিশ্লেষকরাও বলেছেন, আন্তর্জাতিক পরিসরে ট্রাম্প প্রশাসন এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল, যা গোটা বিশ্বকেই অনিরাপদ করে তুলেছে। তারা মনে করেন, সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে একটি নির্বাচনই যথেষ্ট নয়। আগামী কয়েকটি প্রশাসনকেই শুধু এই চার বছরে হওয়া ক্ষতি পোষাতে কাজ করতে হবে।
খোদ মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন ট্রাম্পের মেয়াদকালের মূল্যায়ন করতে গিয়ে মন্তব্য করেছে, ট্রাম্পের হাত ধরে ওয়াশিংটন বহু একনায়ককে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছে। একই সঙ্গে বহুজাতিক অনেক সংস্থার সঙ্গে নিজেদের বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে। আন্তর্জাতিক অনেক চুক্তিকে পায়ে দলে গেছে। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেও গণতান্ত্রিক সব রীতিনীতিকে তিনি ও তার প্রশাসন অগ্রাহ্য করেছে।
মূলত, বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা নেতৃত্ব থাকলেও ট্রাম্প আমলে সেই নেতৃত্বের প্রতি বিশ্ববাসীর আস্থার ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ট্রাম্প আমলে আন্তর্জাতিক কমিউনিটির বিন্যাস ও বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যে ক্ষতি হয়েছে, তা অপূরণীয়। সেই ক্ষতি পোষাতে বিশ্বের এক দশকের বেশি সময় লাগবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অবজ্ঞা আর একনায়ক ও কর্তৃত্ববাদী শাসকদের প্রতি ট্রাম্পের আবেগ ও প্রেমের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে বহু ক্ষেত্রে। ভোটাধিকার না থাকা সৌদি আরবের রাজপরিবারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনে বৈশ্বিক নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। সেখানে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে ট্রাম্প বর্ণনা করেছেন নিজের ব্যক্তিগত বন্ধু হিসেবে। শুধু কি তাই? তার মতে, সালমান নাকি চমৎকার কিছু কাজ করেছেন।
কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাশাসক আর একনায়কদের প্রতি ট্রাম্পের ছিল অবিশ্বাস্য অনুরাগ। নামকাওয়াস্তে গণতন্ত্র রয়েছে কিংবা গণতন্ত্রের আড়ালে যেসব দেশে আদতে কর্তৃত্ববাদী শাসনই চলছে সেসব দেশ আর শাসকদের প্রতি ট্রাম্প উদার দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছেন। বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
যেমন বলা যেতে পারে, এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বাজে স্বৈরশাসন চলছে উত্তর কোরিয়ায়। যেখানে বিরোধিতা মানেই কারাভোগ এবং প্রতিপক্ষ মানেই মৃত্যুদণ্ড। অথচ ট্রাম্পের চোখে উত্তর কোরিয়ার একনায়ক কিম জং উন একজন সত্যিকারে নেতা যার সঙ্গে তিনি সত্যিই ভালো কাজ করতে পারেন।
রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কিংবা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানকে নির্বাচনে জয়ের জন্য অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন ট্রাম্প। অথচ এই দেশ দুটিতে নির্বাচন শুধু আনুষ্ঠানিকতা সারতে হয়েছিল বলে অভিযোগ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহলের।
স্বৈরশাসকদের নিয়ন্ত্রণে রাখা কিংবা ভয়ানক অপরাধের ক্ষেত্রে চুপ থাকার প্রবণতা দেখিয়েছেন ট্রাম্প। যার প্রমাণ মেলে সাংবাদিক জামাল খাসোগির হত্যাকাণ্ডে। সৌদি আরবের ঘাতক দল যখন ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে ওই সংবাদিককে হত্যা করল, তখন গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে দূষিত ও হিংস্র অঞ্চল হিসেবে আখ্যা দিয়ে দিয়ে বন্ধু সৌদি যুবরাজের পাশেই দাঁড়িয়েছেন।
বৈশ্বিক করোনা মহামারি নিয়ে ট্রাম্পের ভূমিকা বরাবরই বিতর্কিত। মাঝপথে এসে চীনের দিকে ঠেলে দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অর্থ সহায়তা বন্ধ করে দেন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রে যখন করোনায় সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যুর পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছিল তখন তিনি মাস্ক পরা নিয়ে হাসিঠাট্টা করছিলেন। আবার করোনা গরম এলেই বিদায় নেবেন বলে অযৌক্তিক তত্ত্ব প্রচার করছিলেন।
জলবায়ু নিয়ে ট্রাম্পের জ্ঞান আর ভূমিকায় গোটা বিশ্বই হতভম্ব। তিনি যখন প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে যান, তখন গাছ কাটা কমানোর জন্য ব্রাজিলের প্রতি আন্তর্জাতিক কমিউনিটির আহ্বান জানানোর ক্ষমতাও খর্ব করে দেন।
মূলত, ট্রাম্পের একলা চলো নীতির কারণে গোটা বিশ্বে বহুমুখী ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ন্যাটো ও জাতিসংঘের মতো সংস্থার সমালোচনার মধ্য দিয়ে তিনি যুগ যুগ ধরে সততা ও বিশ্বস্ততাকে পুঁজি করে গড়ে ওঠা ভিত্তিকে বিতর্কিত করে তুলেছেন। পাশাপাশি তার নেতৃত্বের অনিয়ন্ত্রিত ও অসংযত ধরন সারা বিশ্বেই মার্কিন প্রেসিডেন্সি ধারণায় বদল এনেছে। বলা যায়, গণতান্ত্রিক দেশগুলো এখন সংকটকালে আর যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকানোটাকে প্রথম পছন্দ বলে মনে করছেন না।
ট্রাম্প যে ওভাল অফিস থেকে চলে গেলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুক্তরাষ্ট্র এসব সমস্যা কাটিয়ে উঠবে এমনটা কিন্তু নয়। জো বাইডেন ট্রাম্পের স্থলাভিষিক্ত হলে তাঁকে এসব সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। তবে গোটা বিশ্বজুড়েই ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে যে আস্থাহীনতার স্তরে নিয়ে গেছেন, সেখান থেকে রাতারাতি উত্তরণের পথ তৈরি হবে- এমনটা ভাবছেন না বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ জার্নাল/এমএম