রবিউল ইসলাম জীবন: এক স্বপ্নজয়ী গীতিকবির গল্প
কামরুল ইসলাম
প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০১৭, ১৭:৫০ আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০১৭, ১৯:৪১
শূন্য থেকে শতকে আসা এক সফল তরুণের গল্প এটি। অপ্রতিরোধ্য গতিতে যার এগিয়ে চলা। সময়ের সঙ্গে যিনি নিজেকেই ছাড়িয়ে গেছেন। অর্জন করে নিয়েছেন অসামান্য জনপ্রিয়তা। কলমের আঁচড়ে সৃষ্টি করে চলেছেন হাজারও মানুষের মনের ছন্দ। যার সৃষ্ট অন্তমিলে সুর বসিয়ে গাইতে চান দেশের যেকোনো সংগীত তারকা। হ্যাঁ, বলছি স্বনামধন্য গীতিকবি রবিউল ইসলাম জীবনের কথা।
তরুণ প্রজন্মের অন্যতম জনপ্রিয় এবং সফল গীতিকবি জীবন। তাকে নিয়ে বাড়িয়ে বলারও কিছু নেই। কারণ নিজের যোগ্যতায় মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। গত এগারো বছর ধরে উপহার দিয়েছেন অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গান। লিখেছেন দেশের জনপ্রিয় প্রায় সব শিল্পীর জন্য। সফল এই গীতিকবির জন্মদিন আজ, শনিবার (১১ নভেম্বর)। এই বিশেষ দিনে জীবনের ক্যারিয়ার ও গানের ভুবনে আসার গল্প প্রসঙ্গে জেনে নেওয়া যাক।
দুরন্ত কৈশোরের জীবন: জন্ম নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের হাজিপুর গ্রামে। গ্রামের অন্য আট-দশটা কিশোরের মতো জীবনও ছিলেন এক দুরন্ত বালক। সারাদিন খেলাধূলা আর বন্ধুদের সঙ্গে হইহুল্লোড় করেই কাটতো। কিন্তু নিয়তির নির্মমতায় মাত্র ৪ বছর বয়সেই বাবাকে হারান। তারপর এক কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়ে জীবনের ছেলেবেলা। তবুও মায়ের অদম্য চেষ্টা আর মামাদের ভালোবাসায় জীবন ধীরে ধীরে স্কুলের গণ্ডি পার করেন। শত আবদার চোখের জলে মুছে ফেলে নতুন করে এগিয়ে চলার স্বপ্ন দেখেন। গ্রামের স্কুল থেকে মাধ্যমিক পেরিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য পাড়ি জমান চট্টগ্রামে। সরকারি কমার্স কলেজে (চট্টগ্রাম) শুরু হয় নতুন জীবনের পথচলা।
গানের খাতায় হাতেখড়ি: তখন ২০০২ সাল। একদিন কলেজ থেকে বাসায় ফিরছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে হঠাত মাথায় কয়েকটি লাইন আসে। বাসায় গিয়ে লিখে রাখেন কাগজে। জীবন তখন ভেবে দেখলেন লাইনগুলো গানের মতই। তারপর গানের সাধারণ আঙ্গিকে তিনটি অংশ পূরণ করেন। নিজের কাছেই ভালো লেগে গেলো! এরপর একে একে লিখে ফেললেন ৫০টি গানের কবিতা। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে গানগুলোকে শিল্পীর কণ্ঠে গাওয়ানোর স্বপ্ন। এই ফাঁকে এইচএসসি’র পাঠ চুকে যায়। হাতের ৫০টি গীতিকবিতা আর হাজার খানেক টাকা নিয়ে ২০০৪ সালে চলে আসেন স্বপ্নের শহর ঢাকায়। সরকারি তিতুমীর কলেজে ভর্তি হন বিবিএস’এ। পড়াশোনার পাশাপাশি খুঁজতে থাকেন গান প্রকাশের বিভিন্ন মাধ্যম। দিনের পর দিন যায়, স্বপ্ন হাতে ধরা দেয় না। দমে যাওয়ার পাত্র নন জীবন। হতাশাকে এড়িয়ে নিজের গতিতে ছুটে চলেন শহুরে রাস্তায়। কয়েকটি টিউশনি করে নিজের খরচ চালিয়ে কখনো শিল্পী, কখনো সুরকার আবার কখনো সংগীত পরিচালকদের খোঁজে স্টুডিওতে যেতে থাকেন। ২০০৫ সালে লেখালেখি শুরু করেন দৈনিক সমকাল পত্রিকার ফান ম্যাগাজিন ‘দূরবীন’-এ । কিছু দিন পর বন্ধ হয়ে যায় সেই ম্যাগাজিন। মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ে। ততদিনে লেখালেখির জন্য ছেড়ে দেন টিউশনও। ভাগ্যক্রমে সমকাল পত্রিকাতেই বিনোদন বিভাগে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যান জীবন।
স্বপ্নপূরণের গান: ৪ বছর রাজধানীর পথে ছুটতে ছুটতে অবশেষে ২০০৭ সালে জীবনের হাতে ধরা দেয় তার স্বপ্ন। এ বছরের প্রথম দিন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা আসিফের ‘হৃদয়ে রক্তক্ষরণ’ অ্যালবামে জীবনের লেখা দু’টো গান প্রকাশ হয়। ‘ভাড়াটিয়া চাই’ এবং ‘ভালোবাসি বলে’ শীর্ষক এই দুই গান জীবনের জন্য বয়ে নিয়ে আসে অন্য এক জীবনের বারতা। দু’টো গানই সেই সময় শ্রোতারা দারুণভাবে গ্রহণ করেন। সুরকার-সংগীত পরিচালকদের নজরে আসতে থাকেন জীবন। তার গানের চাহিদা বাড়তে থাকে। দিনে দিনে এগিয়ে চলতে থাকেন গীতিকার রবিউল ইসলাম জীবন।
জীবনের কথায় কণ্ঠ দিয়েছেন যারা: দীর্ঘ এগারো বছরে রবিউল ইসলাম জীবনের লেখা প্রায় ৬০০ গান প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে অসংখ্য গান হয়েছে জনপ্রিয়। তার লেখা গানে কণ্ঠ দিয়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রজন্মের অনেক জনপ্রিয় ও গুণী শিল্পী। এর মধ্যে রয়েছেন রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন, কুমার বিশ্বজিৎ, ফেরদৌস ওয়াহিদ, আইয়ূব বাচ্চু, শাফিন আহমেদ, মাহমুদুজ্জামান বাবু, পার্থ বড়–য়া, বেবী নাজনীন, ফাহমিদা নবী, সামিনা চৌধুরী, ডলি শায়ন্তনী, আলম আরা মিনু, এসআই টুটুল, পলাশ, রবি চৌধুরী, বিপ্লব, আগুন, বাপ্পা মজুমদার, আসিফ, বালাম, ইবরার টিপু, শফিক তুহিন, আঁখি আলমগীর, তপু, মিলন মাহমুদ, মিলা, ন্যান্সি, কনা, দিনাত জাহান মুন্নী, কানিজ সূবর্ণা, জুলি, এলিটা, পড়শী, মিলন মাহমুদ, আরফিন রুমি, হƒদয় খান, তৌসিফ, কাজী শুভ, ইমরান, বেলাল খান, পূজা, কোনাল, নওমী, রিজভী ওয়াহিদ, শহীদ, রমা, জুয়েল মোর্শেদ, অপু, লিজা, ইলিয়াস, মোহাম্মদ মিলন, ঐশী প্রমুখ।
ভারতীয় শিল্পীদের কণ্ঠে জীবন: শুধু দেশের শিল্পী নয়, পার্শবর্তী দেশ ভারতের অনেক জনপ্রিয় শিল্পীও গেয়েছেন জীবনের কথায়। এরই মধ্যে ভারতীয় শিল্পীদের কণ্ঠে তার লেখা ২০টি গান প্রকাশ হয়েছে। শুভমিতা, জুবিন নাটিয়াল, মোহাম্মদ ইরফান, আকাশ সেন, রূপম ইসলাম, রূপঙ্কর বাগচী, ইমন চক্রবর্তী, আকৃতি কাক্করের মতো শিল্পীরা তাদের কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন নোয়াখালীর এই কৃতি সন্তানের লেখা গান।
বিষয়ভিত্তিক গান: গানের খাতায় কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডিতে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেননি রবিউল ইসলাম জীবন। প্রেম-বিরহের সঙ্গে শব্দের মিলনে তুলে এনেছেন মানবতা ও মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধের কথা। অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটকে। লিখেছেন বিভিন্ন চ্যানেল, সামরিক বাহিনী ও ব্র্যান্ডের থিম সং। এর মধ্যে রয়েছে এনটিভির থিম সং ‘সময়ের সাথে আগামীর পথে’, পদ্মসেতু সিম সং ‘ড্রিম কামস ট্রু–’, পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে ‘হেসে উঠে বাংলাদেশ’, আজম খান স্মরণে ‘গুরু তোমায় সালাম’, নারীদের নিয়ে বিশেষ গান ‘নারী’, একুশে বইমেলা নিয়ে ‘একুশে বইমেলা’ ইত্যাদি।
চলচ্চিত্রে জীবনের গান: অডিও ইন্ডাস্ট্রিতে অসামান্য জনপ্রিয়তা অর্জনের পাশাপাশি চলচ্চিত্র থেকেও জীবনের কাছে ভুরিভুরি গানের প্রস্তাব আসতে থাকে। গল্প এবং নির্মাতা-শিল্পীর বাছ-বিচার করে জীবন এরই মধ্যে অনেকগুলো চলচ্চিত্রের জন্য গান লিখেছেন। ‘টেলিভিশন’, ‘অগ্নি’, ‘রাজত্ব’, ‘হানিমুন’, 'রানা পাগলা: দ্য মেন্টাল’, ‘সম্রাট’, ‘আইসক্রিম’, ‘রক্ত’, ‘বসগিরি’, ‘প্রেমী ও প্রেমী’, ‘ধ্যাত্তেরিকি’, ‘সুলতানা বিবিয়ানা’, ‘দুলাভাই জিন্দাবাদ’ প্রভৃতি ছবি উল্লেখযোগ্য।
ক্রিকেটে জীবন: গীতিকবি রবিউল ইসলাম জীবনের আরেকটি বিশেষ পরিচয় রয়েছে। তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘পাগলা ভক্ত’! হাজারও ভক্তের কাছে তিনি আদর্শ। সময়ে-অসময়ে দেশের ক্রিকেটকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। দেশের খেলা দেখার জন্য ছুটে গিয়েছেন সুদূর শ্রীলংকাতেও। দেশে বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা হয়েছে, আর গ্যালারিতে বসে হাততালি দেননি জীবন, এমনটা দেখা যায় না তেমন। জীবনের এমন ভালোবাসায় উজ্বীবিত হন তার ভক্তরাও। শুধু তাই নয়, ক্রিকেট নিয়ে লিখেছেন প্রায় ১৫টির মতো গান। যারমধ্যে কয়েকটি পেয়েছে বেশ জনপ্রিয়তা। ক্রিকেট নিয়ে জীবনের লেখা গানগুলোর মধ্যে রয়েছে- জ্বলে ওঠো বাংলাদেশ (দূরবীন), জয় হবেই হবে (ইমরান ও পড়শী), মাশরাফি (আবরার সিয়াম), কোটি প্রাণের আশা (দূরবীন), প্লে ফর দ্য গেম (তৌসিফ ও মিক্সড), রংপুর রাইডার্স থিম সং (কনা ও পলাশ নূর), বাড়ো আগে বাড়ো (ফেরদৌস ওয়াহিদ, আরফিন রুমি, লিজা, ইলিয়াস), জাগো বাংলাদেশ (বেলাল খান ও মিক্সড), বিজয়ের ডাক (তৌসিফ), চলে এসো (পারভেজ সাজ্জাদ), আগাম শুভেচ্ছা (টিপু, অবসকিউর), বিশ্ব নাচে (মিলা), বাংলাদেশ এগিয়ে যাও (মেহরাব, ঐশী, নাউমি, মুসান্না) প্রভৃতি।
প্রকাশের অপেক্ষায়: নিত্য দিনের ব্যস্ততা কাটিয়ে জীবনের কলম চলছে অবিরাম। প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে অনেকগুলো গান। এর মধ্যে ইমরান ও পড়শীর দ্বৈত অ্যালবাম ‘আবদার’, ইমরান ও বৃষ্টির তিন গানের ইপি, ন্যানসির তিন গানের ইপি, এন্ড্রু কিশোরের ইপি, দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের থিম সং প্রভৃতি। চলচ্চিত্রের গানও রয়েছে। বহুল আলোচিত ‘পাষাণ’ ও ‘আমি নেতা হবো’ এরমধ্যে অন্যতম।
জীবনের সেরা ২০: জীবনের লেখা অনেক গান হয়েছে শ্রোতাপ্রিয়। বিভিন্ন গানের শ্রোতা ভিন্ন। তারপরও সার্বিক দিক বিচারে অনেক গান সবার কাছেই পেয়েছে গ্রহণযোগ্যতা। এর মধ্যে সেরা ২০টি গানের নাম- ১. জ্বলে উঠো বাংলাদেশ-দূরবীন, ২. মানে না মন -ইমরান ও পূজা, ৩. একমুঠো স্বপ্ন-বেলাল খান ও মোহনা, ৪. চোখেরই পলকে-শুভমিতা ও রিজভী ওয়াহিদ, ৫. লজ্জা-পড়শী, ৬. কোথায় যাবি-জুয়েল মোর্শেদ ও কনা, ৭. কেউ না জানুক-তাহসান, ৮. আমার মতন কে আছে বলো-আকাশ সেন, ৯. না বলা কথা ২-ইলিয়াস ও অরিন, ১০. শেষ সূচনা-ইমরান, ১১. জনম জনম-ইমরান ও পড়শী, ১২. কেনো বারেবারে-ইমরান ও পূজা, ১৩. মন তোকে ছাড়া বোঝে না রে-আকাশ সেন, ১৪. দেয়ালে দেয়ালে-মিনার, ১৫. কোনো মানে নেই তো-ইমরান ও ন্যান্সি, ১৬. দলিল-ন্যান্সি ও বেলাল খান, ১৭. রাতভর-ইমরান, ১৮. তুমি চোখ মেলে তাকালে-ঐশী ও ইমরান, ১৯. নিশিরাতে-ইমরান, ২০. বউ এনে দে-কাজী শুভ।
গান লিখে রবিউল ইসলাম জীবন অর্জন করেছেন অগণিত মানুষের ভালোবাসা। সেই সঙ্গে পুরস্কারের পাল্লাটাও কম ভারি নয়। তিন বার অর্জন করে নিয়েছেন চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডে সেরা গীতিকারের সম্মান। আরও কিছু পুরস্কার রয়েছে তার ঝুলিতে। পেশাগত কাজে রবিউল ইসলাম জীবন বর্তমানে দেশের একটি প্রথম সারির জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় সিনিয়র সাব এডিটর হিসেবে কর্মরত। কর্মব্যস্ততার ফাঁকেই চলে তার গানের ভুবনের পথচলা।
এক জীবনে রবিউল ইসলাম জীবনের প্রাপ্তি অনেক। তবুও গানের মাঝেই ডুবে থাকতে চান তিনি। লিখে যেতে চান মানুষের জন্য। দেশের সংস্কৃতির জন্য। বাংলা গানকে ছড়িয়ে দিতে চান বিশ্ব দরবারে। মানুষের মনের মধ্যে পরম ভালোবাসায় বেঁচে থাকতে চান যুগের পর যুগ। জন্মদিনে ভক্তদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এই প্রত্যাশাই করেছেন জীবন।
কেআই/