বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই পৌঁছাবে?
জার্নাল ডেস্ক
প্রকাশ : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১৯ আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:২২
বিগত কয়েক বছরে পাঠ্যবই ভারতে ছাপা হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এবার দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই ছাপার কাজ করবে। নতুন শিক্ষাবর্ষে বাড়ছে পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা। এছাড়া পাঠ্যবইয়ে সংযোজন ও বিয়োজন করা হবে। এদিকে নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে বাকি মাত্র এক মাসেরও কম সময়। কিন্তু এখনও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের বই ছাপার কাজই শুরু করতে পারেনি বেশিরভাগ ছাপাখানা। প্রাথমিকের তিনটি শ্রেণির বই ছাপার কাজও কাগজ সংকটে চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ফলে নতুন বছরে নতুন বই হাতে ক্লাসে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর স্কুল পড়ুয়া সোয়া তিন কোটি শিক্ষার্থীর হাতে ঠিক সময়ে বই পৌঁছানো যাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
২০১০ সাল থেকে বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়ার রেওয়াজ শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। সব না হলেও কিছু বই বছরের প্রথম দিনই উঠত শিক্ষার্থীদের হাতে।
গত ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা ভারত উড়ে যান। অন্তর্বর্তী সরকার বিগত সরকারের আমলে প্রবর্তিত নতুন শিক্ষাক্রম ‘বাস্তবায়নযোগ্য নয়' বলে বাতিলের ঘোষণা দেয়। ফলে বছরের শেষাংশে এসে আগামী বছরের জন্য এক যুগ আগের ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমের বই 'ঘষে-মেজে' প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
ওই বইগুলোর ‘বিভ্রান্তিকর তথ্য’, ইতিহাসের ‘বিকৃতি’, ‘ব্যক্তি তোষণ’সহ কিছু বিষয় সংশোধন ও পরিমার্জনে অনেকটা সময় চলে যাওয়ায় প্রেসে তা পাঠাতেই চার মাস দেরি হয়ে যায়।
বই লেখা, মুদ্রণ ও বিতরণ তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড- এনসিটিবির চেয়ারম্যান এ কে এম রিয়াজুল হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, প্রতি বছর জুন মাসে সব বই প্রেসে পাঠানো হয়। তবে ২০১২ সালের কারিকুলামের বই সংশোধন ও পরিমার্জন ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার পর নভেম্বরের শুরুতে আমরা বই ছাপার জন্য পাঠাতে পেরেছি।
দেরি হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, সেপ্টেম্বরে নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল ঘোষণার পর ২০১২ সালের বইগুলো পরিমার্জন ও সংশোধন করতেই সময় গেছে দুই মাস। ওই কারিকুলামে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণির মোট ৬৫৫টি বইয়ের ১৫০টির বেশি পরিমার্জন করা হয়েছে। অক্টোবরের শেষে এসে টেন্ডার প্রক্রিয়া হয়েছে। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে নভেম্বরে ৭০টি লটে প্রাথমিকের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির ৪ কোটি কপি বই ছাপার কাজ শুরু হয়েছে।
দশম শ্রেণির বই ছাপানোর কাজ চলছে। এদিকে প্রাক-প্রাথমিক, চতুর্থ-পঞ্চম ও ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির বইয়ের টেন্ডার প্রক্রিয়াও শেষ। এ অবস্থায় অগ্রাধিকারভিত্তিতে কয়েকটি শ্রেণি ও বিষয়ের বই ছাপানোর উদ্যোগ নিয়েছে এনসিটিবি। ছাপানোর কাজ দেয়া হয়েছে সেনাবাহিনীকেও। চলছে প্রাথমিকের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বই ছাপানোর কাজ।
নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল হয়ে যাওয়ায় চলতি বছর নবম শ্রেণিতে পড়া শিক্ষার্থীরা দশম শ্রেণিতে প্রথমবারের মত নতুন বই পাবেন। দশম শ্রেণির জন্য নতুন বই, ১২ বছর আগের শিক্ষাক্রমে বিষয় বেশি থাকায় গত বছরের তুলনায় বইয়ের সংখ্যা বেড়েছে সাড়ে ৯ কোটি। দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য ছাপা হচ্ছে ৬ কোটি ৬৪ লাখ কপি বই।
এনসিটিবি বলছে, নবম শ্রেণিতে এক শিক্ষাক্রমে পড়েছে, দশম শ্রেণিতে তাদের বিভাগ বিভাজন আসছে। তাই তাদের বইগুলো আগে ছাপানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেন, দশম শ্রেণির বইসহ মোট ১ কোটি কপি বই ‘ডাইরেক্ট পার্চেজ ম্যাথড’ বা সরাসরি ক্রয়াদেশের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে তাদের প্রেসে ছাপানোর জন্য দেয়া হয়েছে। এ বইগুলো ডিসেম্বরের প্রথমার্ধেই হাতে পাওয়া যাবে।
ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এবং বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচিতি বইগুলোও আগে ছাপানোর জন্য দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ। জানিয়ে তিনি বলেন, বইগুলো ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে যাবে।
প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ১ কোটি ৯৭ লাখের বেশি শিক্ষার্থী আগামী বছর ১০ কোটি কপির বেশি নতুন বই হাতে পাবে। তাদের মধ্যে প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির ৪ কোটির বেশি বই ছাপানোর কাজ ৭০টি লটে পেয়েছে ৪১টি প্রতিষ্ঠান।
প্রাথমিকের বই ছাপানোর কাজ পাওয়া মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান লেটার অ্যান্ড কালার লিমিটেডের প্রতিনিধি এ কে এম রাশেদুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, কাগজ সংকটে বই ছাপানোর কাজ আগানো চ্যালেঞ্জিং। ৮৫ শতাংশ ব্রাইটনেস সমৃদ্ধ পাল্পের কাগজ এই বইগুলো ছাপানোর কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে মাত্র ৫টি পেপার মিল এ মানের কাগজ সরবরাহ করছে। ২৪ টন কাগজ অর্ডার দিয়ে পেয়েছি মাত্র ৫ টন।
কার্যাদেশ ও প্রিন্ট অর্ডার আগে হলেও পরিমার্জনের পর বইগুলোর সফট কপির সিডি অনেক পরে দেয়ার পরেও সেগুলো প্রত্যাহার করে আবার সিডি দেয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, তাই বেশ কিছুদিন বসে থাকতে হয়েছে।
ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ছাপার কাজ শেষ করা যাবে বলেও মনে করেন তিনি।
মাধ্যমিক পর্যায়ের ১ কোটি ২১ লাখ শিক্ষার্থী আগামী বছর প্রায় ৩০ কোটি বই পাবে। কিন্তু ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির বই ছাপানোর কাজ শুরুই হয়নি। নবম শ্রেণির বই ছাপানোর দরপত্র প্রক্রিয়াও বাকি আছে।
লেটার অ্যান্ড কালার লিমিটেড ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির বই ছাপানোর কাজও পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিনিধি কে এম রাশেদুজ্জামান বলেন, ছাপানোর কাজ ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদ শুরু করতে পারব। এখনও সিডি হাতে পাইনি, প্রিন্ট অর্ডারও পাইনি। চলতি ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে হয়ত সিডি পাব, পরের সপ্তাহে হয়ত প্রিন্ট অর্ডার আসবে, তখন প্রডাকশনে যাব।
৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ছাপানো সম্ভব হবে কি-না এই প্রশ্নে তিনি বলেন, তাড়াহুড়ো করে কাজ শেষ করার চেষ্টা করলে প্রিন্ট ভালো হবে না। তখন বইগুলো বাতিল হয়ে যাবে। তবে যথাসম্ভব দ্রুত আমরা কাজ শেষ করার চেষ্টা করব।
আরেক প্রতিষ্ঠান দোহার প্রিন্টিং প্রেসের সত্ত্বাধিকারী মো. আনোয়ার হোসাইন বলেন, ওয়ার্ক অর্ডার, প্রিন্ট অর্ডার এখনও পাইনি, বইয়ের সিডিও হাতে আসেনি, তাই কাজ শুরু করা যায়নি।
এমন বাস্তবতাতেও ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম থেকে তৃতীয় এবং ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির বই ছাপানোর কাজ শেষ হবে বলে আশা করছে এনসিটিবি। সংস্থাটির চেয়ারম্যান বলেন, মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো যদি চায় তাহলে ২১ দিনে সব বই ছাপানো সম্ভব। প্রেসগুলো আন্তরিক হলে বছরের শুরুতেই সব শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দেয়া সম্ভব।
সেনাবাহিনীকে যে এক কোটি বইয়ের কাজ দেয়া হয়েছে, সেগুলোর কাজও ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রয়োজনে তাদের বাকি বই ছাপার কাজে সম্পৃক্ত করা হবে।
চুক্তি অনুযায়ী তারা বই সরবরাহ করতে না পারলে মুদ্রন প্রতিষ্ঠানগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করার পরিকল্পনাও আছে এসসিটিবির। যারা সঠিক সময়ে কাজ শেষ করবে তাদেরকে ভবিষ্যতে অগ্রাধিকার দেয়ার সিদ্ধান্তও আছে তাদের।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, যার যতটুকু অবদান তা অন্তর্ভুক্ত থাকবে পাঠ্যবইতে। শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি পেয়েছিলেন। সে বিষয়গুলো বইয়ে থাকবে। এর সঙ্গে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী ও জিয়াউর রহমানের ভূমিকা অন্তর্ভুক্ত হবে।
জিয়াউর রহমানের বিষয়ে কী থাকছে- এই প্রশ্নে তিনি বলেন, ২৬ ও ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান রেডিওতে ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ দিয়েছিলেন। সে ঘোষণাগুলোও পাঠবইতে অন্তর্ভুক্ত হবে।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ইতিহাসও থাকবে।
কোনো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের অনুভূতিতে আঘাত করার মত কোনো বিষয় স্থান পাবে না জানিয়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, এ বিষয়গুলো সতর্কতার সঙ্গে পর্যালোচনা করা হয়েছে। আগামী বছরের বইতে ‘বিতর্কিত’ কোনো বিষয় নেই।
আগামী বছরের বইতে 'বিবর্তনবাদ তত্ত্ব' থাকছে না জানিয়ে তিনি বলেন, বিবর্তনবাদ ‘তত্ত্বীয় বিষয়’। এ বিষয়টি প্রাথমিক বা মাধ্যমিকে পর্যায়ের পাঠ্যবইতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত সংশোধন ও পরিমার্জন প্যানেল দেখেনি।
এনসিটিবির শিক্ষাক্রম উইংয়ের সদস্য অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী বলেন, এ শ্রেণিগুলোতে ঐচ্ছিক বিষয় হিসাবে আরবি থাকছে। ইসলাম ধর্ম বইগুলোতে কোরআনের আয়াত আরবিতে থাকছে। আগে ইসলাম শিক্ষা বইতে শুধু আয়াতের বঙ্গানুবাদ ছিল।
সূত্র: বিডিনিউজ
বাংলাদেশ জার্নাল/আরএইচ