ঢাকা, বুধবার, ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১৮ আশ্বিন ১৪৩১ আপডেট : ২১ মিনিট আগে
শিরোনাম

গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে টানা অস্থিরতার কারণ কী, বিবিসির মূল্যায়ন

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১৬:৫৭

গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে টানা অস্থিরতার কারণ কী, বিবিসির মূল্যায়ন
গত বেশ কয়েকদিন ধরেই গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে অস্থিরতা চলছে। ফাইল ছবি

গত বেশ কয়েকদিন ধরেই গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে অস্থিরতা চলছে। সরকারের নানামুখী উদ্যোগ সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ঘাটতি, ঝুটসহ কারখানা সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, কিছু কারখানার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তৎপরতা, বেতন ভাতা সংক্রান্ত সমস্যা এবং বাইরের ইন্ধনসহ বিভিন্ন কারণে পোশাক কারখানাগুলোতে অস্থিরতা বন্ধ হচ্ছে না। কয়েকটি কারখানার মালিক, শ্রমিক নেতা ও কারখানা সংশ্লিষ্ট স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে।

বিজেএমইএ ও পোশাক খাতের নেতারা জানান, গত কয়েক দিনে অন্তত ২৫টি কারখানা বন্ধ হয়ে পড়েছে। তবে এর মধ্যে কয়েকটি খোলার প্রক্রিয়া চলছে। যদিও পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আগামী দু মাসে আরও কিছু কারখানা বন্ধ হওয়ারও আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।

এ অবস্থায় চাকরিতে নিয়োগ ও পুনর্বহালসহ বিভিন্ন দাবিতে গাজীপুর এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধের পর অন্তত দশটি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করতে হয়েছে বুধবার। অন্যদিকে, একটি কারখানার শ্রমিকরা দুদিনেরও বেশি সময় আশুলিয়ায় অবরোধ কর্মসূচি পালনের পর সেনাবাহিনীর আশ্বাসের প্রেক্ষিতে আজ তা প্রত্যাহার করেছে।

এর আগে গত মাসেও বিভিন্ন দাবিতে আশুলিয়া অঞ্চলের পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করেছেন। শ্রমিকদের টানা বিক্ষোভের জের ধরে শেষ পর্যন্ত তাদের ১৮ দফা দাবি বাস্তবায়নে সম্মত হয় মালিকপক্ষ। ২৪ সেপ্টেম্বর মালিক ও শ্রমিকেরা একটি যৌথ ঘোষণাও দিয়েছেন।

এতে বলা হয়েছিলো, দেশের পোশাক শিল্পের সব কারখানার শ্রমিকদের মাসিক হাজিরা বোনাস ২২৫ টাকা বাড়ছে। টিফিন ও রাত্রিকালীন ভাতাও (নাইট বিল) বাড়বে। আগামী অক্টোবরের মধ্যে বিদ্যমান ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন করা হবে।

বিজেএমইএ’র সিনিয়র সহসভাপতি আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, পাঁচই অগাস্টের পট পরিবর্তনের পর শিল্প জোনগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বের শিকার হচ্ছে পোশাক খাত। আইনশৃঙ্খলা সমন্বয়েও ঘাটতি আছে। এছাড়া লেবার লিডার, রাজনৈতিক দল, বাইরের ইন্ধনসহ বিভিন্ন ইস্যু আছে। তবে আশা করি আগামী দশদিনে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার বলেন, সংকট নিরসনে নেয়া পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে শ্রমিকদের যথাযথ অবহিত করায় ঘাটতি আছে। একই সাথে পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে কোন একটি পক্ষ চাচ্ছে না যে পরিস্থিতি শান্ত হোক। এতে রাজনৈতিক মোটিভও থাকতে পারে।

শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে। প্রায়ই সহিংস আকার ধারণ করছে তাদের আন্দোলন

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও পোশাক খাতের একজন উদ্যোক্তা এ কে আজাদ বলেন, অস্থিরতা কেন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না সেটা তারা নিজেরাও বুঝতে পারছেন না। কিছু কারখানায় বেতন ভাতা সংক্রান্ত সমস্যা আছে, সেটা বিজিএমইএ দেখছে। এর বাইরে নানা কারণ দেখিয়ে হুটহাট সমস্যা তৈরি করা হচ্ছে। এর সাথে শ্রমিকদের চেয়ে বাইরের লোকজন বেশি সম্পৃক্ত মনে হচ্ছে।

মালিক ও শ্রমিকদের বিভিন্ন পক্ষ বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, যারা বিভিন্ন কারখানায় পাঁচই অগাস্টের আগে চাকরি হারিয়েছিলো, নতুন পরিস্থিতিতে তাদের চাকরি ফেরত পাওয়ার দাবি থেকেই এবারের অস্থিরতার সূত্রপাত।

জানা গেছে, ২০২৩ সালের মজুরি বৃদ্ধির পর অনেক কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটে, যাদের অধিকাংশ ছিলেন অভিজ্ঞ শ্রমিক। এসব শ্রমিকরা বেশিরভাগই আর কোথাও চাকরি পাননি। সরকার পরিবর্তনের পর তারাই কারখানাগুলোতে জড়ো হয়েছে চাকরি ফিরে পেতে। আবার কিছু কারখানায় জুলাই অগাস্টের বেতন এখনো হয়নি, ফলে সেগুলোতেও শ্রমিকদের মধ্যে নতুন করে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিলো, যার জেরে পুরো সেপ্টেম্বর জুড়েই বিক্ষোভ হয়েছে শিল্পাঞ্চলগুলোতে।

অন্যদিকে, স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগের লোকজন নিয়ন্ত্রণ হারানোর পর বিএনপির পরিচয়ধারী ব্যক্তিরা পোশাক কারখানার বড় বড় জোনগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করছে। তবে এর মধ্যে আশুলিয়া জোনে এখন দু পক্ষই নিয়ন্ত্রণে আছে বলে জানাচ্ছেন স্থানীয়রা। মূলত ঝুট ব্যবসাসহ পোশাক কারখানা সংশ্লিষ্ট আরও কিছু ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতেই স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা নানাভাবে চেষ্টা করেন সবসময়। এতদিন যারা কোটি কোটি টাকার ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলো তাদের অনেকেই এখন পলাতক। এছাড়া শ্রমিকদের মধ্যেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সমর্থিত ব্যক্তিরা আছেন।

কারখানাগুলোতে গত দুই দশক ধরেই মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে শ্রমিকদের দূরত্ব ছিল। দাবি দাওয়া উত্থাপনে শ্রমিকদের মধ্যে একটি ভয়ের সংস্কৃতি কাজ করতো। এখন সরকার পরিবর্তনের পর শ্রমিকরা কথা বলতে শুরু করেছেন বলে জানিয়েছেন গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা মমিনুর রহমান।

তিনি বলেন, অনেক কারখানায় সাবেক সরকারের সংশ্লিষ্ট লোকজন মালিক। সেখানে এখন উৎপাদন সমস্যা তৈরি হয়েছে। ফলে গত মাসের বেতন পরিশোধ হয়নি। আবার কিছু কারখানায় ব্যবসায় ভালো যাচ্ছিলো না গত এক বছর ধরেই। ২/৩ মাস বকেয়া পড়ে গেছে। এখান থেকেই মূলত এবারের আন্দোলনের সূত্রপাত। পরে তা ছড়িয়ে গেছে। ফলে ভালো কারখানায়ও কিছু ঘটনা ঘটেছে।

শ্রমিকদের আন্দোলনে প্রায়ই বন্ধ হয়েছে পোশাক কারখানা

অন্যদিকে এতদিন গাজীপুর আশুলিয়া এলাকায় শ্রমিক বিক্ষোভ বা এ ধরনের পরিস্থিতিতে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ মূল ভূমিকা রাখতো। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর পুলিশের পুরো কাঠামোই ভেঙে পড়ায় গত এক মাস ধরে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।

বিজিএমইএ সহসভাপতি আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, তাদেরও সব নতুন। তারা বুঝে কাজ শুরু করতে সময় লাগবে। তবে আশা করছি দ্রুতই তারা কার্যকর ভূমিকা পালন করতে শুরু করবে।

মমিনুর রহমান রহমান বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে আগে সব বকেয়া বেতন ভাতা ঠিক মতো পরিশোধ করতে হবে।

“যেসব মালিক বা কর্তৃপক্ষ পালিয়ে গেছে তাদের বন্ধ কারখানা সচল করতে হবে। পাশাপাশি কর্মকর্তাদের সাথে শ্রমিকদের সম্পর্ক উন্নয়ন করে কারখানার ভেতরের পরিবেশ ভালো করতে পারলে বাইরের সুযোগসন্ধানীরা কোনো সুযোগ নিতে পারবে না,” বলছিলেন তিনি।

ওদিকে, সোমবার পোশাক শ্রমিকদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষে একজনের মৃত্যুর পর সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল এবং তারা দেখেছে যে এই ঘটনাগুলোয় সুনির্দিষ্ট কিছু মানুষ উস্কানি দিয়েছে। সোমবারের ঘটনায় শ্রমিকদের মধ্য থেকেই অনুপ্রবেশকারী বা এ রকম কেউ গুলি ছুড়েছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এর আগে, গত ২৪ সেপ্টেম্বর শ্রমিকদের আঠারোটি দাবির সব মেনে নিয়ে মন্ত্রণালয়ের একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই হয়েছিলো। ওই চুক্তির পর শিল্পাঞ্চলগুলোতে স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হবে বলে আশা করেছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা।

তবে কল্পনা আক্তার বলেন, এ চুক্তির তথ্য যথাযথভাবে কারখানাগুলোতে পৌঁছেনি বলে শ্রমিকদের মধ্যে মজুরি বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ আছে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা কার্যক্রম এখনো পুরোদমে শুরু হয়নি। কোনো কারখানায় সমস্যা দেখা দিলে প্রশাসনের কার্যকর উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে না। শুধু সেনাবাহিনী দিয়ে তো এসব নিয়ন্ত্রণ কঠিন।

বাংলাদেশ জার্নাল/এমপি

  • সর্বশেষ
  • পঠিত