ঢাকা, শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ আপডেট : ১ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

যে কারণে রোহিঙ্গারা জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি

  ইফতেখার উদ্দীন

প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৯:৪৮  
আপডেট :
 ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২২:৩৮

যে কারণে রোহিঙ্গারা জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন মিয়ানমার সেনাবাহিনী হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম হত্যা করে দেশত্যাগে বাধ্য করছে। খুন-ধর্ষণ আর লুটের রাজত্ব চলছে আরকানে। একটি জাতিকে নিশ্চিন্হ করে দেয়ার মধ্যযুগীয় ববর্রতার সীমা অতিক্রম করেছে । মানবিক কারণে এসকল সাধারণ জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে ।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে জানা যায়, কক্সবাজারের মোট জনগোষ্ঠীর ২০ থেকে ২৫ ভাগই রাখাইন প্রদেশের মুসলিম রোহিঙ্গা। এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী ভবিষ্যতে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। বর্তমানে পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছে।

কয়েক দশক ধরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে আহ্বান জানালেও সাড়া দেয়নি মিয়ানমার। এই মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নিজেদের নাগরিক বলেও অস্বীকার করে আসছে মিয়ানমার। মিয়ানমার থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচিত হলেও বাংলাদেশ সরকার তাদের রাখাইন প্রদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী বলে আখ্যায়িত করে।

রোহিঙ্গা শরনার্থী ক্যাম্প থেকে দেশীয় অস্ত্র ও কার্তুজসহ এক মহিলা

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে চাপ দেওয়ার পাশাপাশি ‘মানবিক কারণে’ তাদের নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপে সরানোর পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছিল সরকার। তখন বিভিন্ন মহলের আপত্তির পাশাপাশি সংসদেও এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা আসে।

আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকরা বাংলাদেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, পরিবেশগত ও জাতীয় নিরাপত্তায় হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইতোমধ্যেই তার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। মিয়ানমারের নাগরিকদের দ্বারা বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।

তারা বিভিন্ন প্রকার অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটাচ্ছে। তারা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক ভারসাম্য, শ্রমবাজার ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

জানা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে নিবন্ধিত ৩৩ হাজার এবং সাড়ে ৪ লাখ অনিবন্ধিত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক কক্সবাজারসহ পাঁচটি জেলায় অবস্থান করছে। এসব জনগোষ্ঠী সীমান্তে মাদকদ্রব্য পাচার, অস্ত্র ও মানব পাচার, চোরাচালান, সীমান্ত মাদক উৎপাদনসহ বিভিন্ন অসামাজিক কাজে লিপ্ত রয়েছে। সীমান্ত এলাকায় অপরাধ চক্র তৈরি করে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা, জাতিগত নিরাপত্তা, জাতিগত পরিচয় ও আর্থ-সামাজিক স্থিতিশীলতার মারাত্মক ব্যত্যয় ঘটছে। বিভিন্ন কূচক্রী ও দেশবিরোধী মহল তাদের ব্যবহার করছে।

*উখিয়ার থাইংখালীর হাকীমপাড়া এলাকায় কিছু ব্যক্তি মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংগঠিত করে ‘সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জায়গায় কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত অবৈধভাবে’ শরনার্থী ক্যাম্প স্থাপন এবং ক্যাম্প পরিচালনার জন্য গোপনে একটি কমিটি করার অভিযোগে কক্সবাজারের উখিয়ায় ছয় জনকে কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

*গত ৪ জুলাই টেকনাফ মডেল থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে দেশীয় তৈরী অস্ত্র ও বুলেটসহ শফিক নামে ১ রোহিঙ্গা ডাকাতকে আটক করেছে।

রোহিঙ্গা হামলায় নিহত আনসার কমান্ডারের লাশ নিয়ে যাচ্ছে সহকর্মীরা

* ১৬ সালের ১১ মে রাতে টেকনাফের শরণার্থী শিবিরে আনসার ক্যাম্পে একদল রোহিঙ্গা দুবৃত্ত হামলা চালায়। তাদের বাধা দিতে গিয়ে নিহত হন আনসার কমান্ডার টাঙ্গাইলের সখীপুরের আলী হোসেন। পরে অস্ত্র লুটের ঘটনার অন্যতম হোতা খাইরুল আমিন (বড়) ও মাস্টার আবুল কালাম আজাদ নামের দুই রোহিঙ্গাকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করে র্যাব-৭। ৫টি অস্ত্র, দেশীয় ৫টি অস্ত্র, ১৮৯ রাউন্ড চাইনিস রাইফেলের গুলি ও ২৬টি দেশীয় তৈরি গুলি উদ্ধার করা হয়।

*বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ঢিকুবনিয়া শূন্যরেখায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে গত ১৩ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারের গুপ্তচর সন্দেহে আটক করা হয়েছে।

*গত ১০ আগস্ট কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর ফিশারিঘাট এলাকা থেকে অস্ত্র ও কোটি টাকার ইয়াবাসহ আবদুল্লাহ নামে মিয়ানমারের এক রোহিঙ্গাকে আটক করে ডিবি পুলিশ।

এছাড়াও অহরহ তাদের দিয়ে সকল অনৈতিক ও অপরাধমূলত কার্যক্রম করানোর অভিযোগ রয়েছে। রোহিঙ্গারা প্রতিনিয়তিই অনৈতিক কাজের সাথে জড়াচ্ছে। এতে করে বাড়ছে অস্থিরতা।

র‌্যাবের হাতে আটক অস্ত্রলুট ও আনসার হত্যায় আটক রোহিঙ্গা

কক্সবাজার উখিয়ার বাসিন্দা আবদুল হাই বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, যে হারে রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে আছে তাতে আমাদের অস্তিত্ব বিলীনের পথে। প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় তারা যে কোনো অনৈতিক কাজ করতে পারে।

জঙ্গি কার্যক্রমে রোহিঙ্গা

কক্সবাজার-বান্দরবান এবং রাঙামাটিতে মধ্যপ্রাচ্যের অনুদানপ্রাপ্ত রাবেতা আল ইসলাম হাসপাতালে পল্লী চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের নামে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সদস্যদের জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। প্রত্যেক হাসপাতালের পাশে রাবেতার নামে আসা অনুদানে মানবতা বিরোধী অপরাধে মৃত্যদণ্ডপ্রাপ্ত মীর কাসেম আলী গড়ে তুলেছিলেন কওমি মাদ্রাসা। সেই মাদ্রাসায় রোহিঙ্গা যুবকদের পাশাপাশি শিবিরের তরুণ সদস্যরাও অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিত।

রোহিঙ্গাদের হাতে দেশি মোবাইল ও সিম

রোহিঙ্গাদের হাতে টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশি সিম তুলে দিচ্ছেন স্থানীয়রা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশের এলাকায় কোনও ধরনের কাগজপত্র ছাড়াই এসব সিম বিক্রি করতে দেখা গেছে। আর নিবন্ধন না থাকায় এসব সিম ব্যবহার করে অপরাধ সংগঠিত হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না কেউ কেউ। রোহিঙ্গারা মূলত বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য দালালদের দারস্ত হয়। এ দালালরাই তাদের বন, জঙ্গল, পাহাড় ও নদী পাড় করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। বাংলাদেশে ব্যবহৃত সিম ও মোবাইলের ব্যবস্থাও তারা টাকার বিনিময়ে করে দেন। তাই কখনও কখনও বাংলাদেশে প্রবেশের আগেই এদেশের সিম পান তারা।

মোটা অংকের টাকায় ভোটার হচ্ছেন রোহিঙ্গারা

মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে রোহিঙ্গারা ভোটার হওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ম্যানেজ করে তাদের এদেশীয় আত্মীয়রা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি হয়ে উঠতে সহায়তা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ প্রেক্ষিতে কমিশনের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি সহায়তা বন্ধে বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এখন থেকে কেউ রোহিঙ্গাদের ভোটার হতে সহায়তা করলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।

ইসি সংশ্লিষ্টরা আরো জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়া ঠেকাতে সবসময়ই তৎপর থাকে কমিশন। বিগত দিনের ভোটার হালানাগাদ তালিকা অনুযায়ী এবারো বিশেষ সর্তকতা ও নানামুখি পদক্ষেপ নিয়ে মাঠে নেমেছেন তারা।

নিবন্ধনে আগ্রহ নেই রোহিঙ্গাদের

গত ১১ আগস্ট রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু হলেও কুতুপালংয়ে মাত্র ৮০০ রোহিঙ্গা নিবন্ধিত হয়েছেন। লাখ লাখ রোহিঙ্গা নিবন্ধন করতে কতদিন লাগবে, তা নির্দিষ্ট করে এখনই বলতে পারছে না স্থানীয় প্রশাসন।

এদিকে মানবিক বিষয়টি মাথায় রেখেই রোহিঙ্গাদের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষকরা জানিয়েছেন, জীবনযাত্রার নূন্যতম মান ঠিক রেখে রোহিঙ্গাদের দেশে রাখতে হলে বছরে সরকারের খরচ বাড়বে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক ও খাদ্য নিরাপত্তায় দেয়া বরাদ্দের সমান।

সীমিত সাধ্যের মধ্যেও বাংলাদেশ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছেন। তাদের থাকা, নিরাপত্তা ও খাবার নিশ্চিত করেছেন। অথচ দেশ বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রোহিঙ্গাদের চাপ বহন করা বাংলাদেশের জন্য সত্যিই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে রোহিঙ্গারা যাতে কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে না জড়ায় সেদিকে নজরদাড়ি রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে কেউ যাতে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে এবং ঝিমিয়ে পড়া জঙ্গিরা যাতে চাঙ্গা না হয়ে উঠে এ জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজরদারি ও তৎপরতা রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত