সুবর্ণচরে ধর্ষণের নেতৃত্বে ছিলেন বিএনপি নেতা: বিচারপতি মানিক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৭ জানুয়ারি ২০১৯, ১৬:০৪ আপডেট : ০৭ জানুয়ারি ২০১৯, ১৬:১২
ভোট দেওয়াকে কেন্দ্র করে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গণধর্ষণের ঘটনায় মূল হোতা রুহুল আমিন আগে বিএনপি করতেন বলে দাবি করেছেন সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। সোমবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে জাগো বাংলা ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত ‘নির্বাচন-২০১৮ : অপরাজনীতির প্রস্থান ও নতুন অধ্যায়ের সূচনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধান আলোচক হিসেবে সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ওই ধর্ষণের ঘটনায় রাজনীতির সম্পর্ক কিন্তু খুবই কম। মহিলা সমিতির দুইজন ইতোমধ্যে ঘুরে এসেছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। ঘটনাটি নেহায়েত ব্যক্তিগত কারণে ঘটেছে। তিনি (অভিযুক্ত ব্যক্তি) অতীতে বিএনপিতে ছিলেন, নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগে জয়েন করেন। তিনি আওয়ামী লীগের অত্যন্ত নিম্নস্তরের নেতা ছিলেন। আওয়ামী লীগ থেকে তাকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো সরকার ওই ঘটনায় “আউট অব দ্য ওয়ে”তে পদক্ষেপ নিয়েছেন। ইতোমধ্যে ৯ জনকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। আমিও চাই তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ সম্পর্কে সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, নির্বাচনে অনিয়মের কথা বলা হয়েছে। এইবার নির্বাচনে বহু দেশের অবজারভার (পর্যবেক্ষক) এসেছিলেন। নেপাল থেকে, ভারত থেকে, ওআইসি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে এসেছিলেন। কেউ কিন্তু মৌলিক অনিয়মের কোনো কথা বলেননি। ছোটখাটো দুই একটি ঘটনা ঘটেছে।
তিনি বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশেই একশ’ ভাগ অনিয়মহীন নির্বাচন হয় না, কোথাও হয় না। এমনকি যুক্তরাজ্যের মতো দেশেও হয় না, এখনও হয় না। যেখানে আমি আমার জীবনের বড় একটা অংশ কাটিয়েছি। সুতরাং একেবারে একশত ভাগ ধোয়া তুলশিপাতার নির্বাচন হবে, এটা আশা করা যায় না। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে এত নিষ্কলুষ নির্বাচন, এত প্রচ্ছন্ন নির্বাচন আমি আগে কখনও দেখিনি, অনেক অবজারভারই দেখেননি।
সাবেক এই বিচারপতি বলেন, বিএনপি-জামায়াত ও ড. কামাল সাহেবরা ভোটের মাধ্যমে জেতার স্বপ্ন দেখেননি। তারা চেয়েছিলেন বিচারপতি সুরেন্দ কুমার সিনহার ((সাবেক প্রধান বিচারপতি)) ঘাড়ে ভর করে একটি জ্যুডিসিয়াল ক্যু (অভ্যুত্থান) ঘটিয়ে দেশের ক্ষমতা দখল করতে। বিশেষ করে ড. কামাল সাহেব এটি চেয়েছিলেন। সেটা হয়নি। আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িতরা সেটা হতে দেননি। আমাদের গোয়েন্দা সংস্থার লোক সিনহার স্বরূপ উন্মোচন করতে পেরেছিলেন। যে কারণে অন্য বিচারপতিরাও তার সঙ্গে বসতে অস্বীকার করেছিলেন। এই কাহিনী সবাই জানেন। যে কারণে ড. কামাল সাহেব ব্যর্থ হয়েছেন।
তিনি বলেন, তারা জানতেন ভোটের মাধ্যমে তারা জিততে পারবেন না। জনগণ তাদের অগ্রাহ্য করবে। বিপুল ভোটে তারা পরাজিত হবে। কিন্তু চেষ্টা করলে ২০/৩০টা আসন পেতে পারতেন। কিন্তু তারা সে চেষ্টাও করেননি। টাকা পয়সাও খরচা করেননি।
ক্যু ঘটাতে ড. কামালের ষড়যন্ত্র প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সাবেক এ বিচারপতি বলেন, ১/১১-এ সিনহাসহ তিনজন বিচারককে ডাকা হয়েছিল বঙ্গভবনে। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অকাট্য প্রমাণ রয়েছে দেখিয়ে সবাইকে পদত্যাগ করতে বলা হয়। একজন পদত্যাগও করেন, ওনি প্রয়াত, তাই তার নাম উল্লেখ করতে চাই না। সিনহা সাব জানালেন, মায়ের সঙ্গে আলাপ করে দুইদিন পর তার সিদ্ধান্ত জানাবেন। ওনি ফিরেই ড. কামালের হাতে পায়ে ধরে বললেন...। ড. কামাল তখন ১/১১ এর দণ্ডমূলের কর্তা। কামাল সাব বাঁচিয়ে দিলেন। শুধু বাঁচিয়েই দিলেন না, ভর করলেন সিনহার কাঁধে। ভাবলেন সিনহাকে দিয়েই তিনি শেখ হাসিনার সরকারকে হটাতে পারবেন। সেটিও সম্ভব হয়নি।
তিনি বলেন, আমাদের সামনে অনেক ষড়যন্ত্র রয়েছে। আমরা ভোটে নির্বাচিত হয়েছি। কিন্তু একটা বিষয় মাথায় রাখাতে হবে যে, ভোটে নির্বাচিত হবার পরও কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে খুন করা হয়েছিল পচাত্তর সনে। আমাদের এসব ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতে হবে।
বিচারপতি মানিক বলেন, মেজর জিয়া মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। তিনি বাধ্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। তবে তিনি মূলত পাকিস্তানি হিসেবেই কাজ করেছেন। তিনি বীর উত্তম খেতাব পেয়েছিলেন সেটা যেমন সত্য তেমনি সত্য তিনি ওপারে মুক্তিযুদ্ধ করেননি। তার মুক্তিযুদ্ধের কোনো ঘটনা আমরা জানি না। কারণ তিনি মুক্তিযুদ্ধই করেননি। তিনি ওপারে গিয়েছিলেন পাকিস্তানি চর হিসেবে। তার পক্ষেও অনেক তথ্য প্রমাণ রয়েছে।
তিনি বলেন, ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যা জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে হয়েছিল। আন্দাজভিত্তিক নয়, সাক্ষ্য ও তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বলছি। জেনারেল শফিউল্লাহ, কর্নেল হামিদ, কর্নেল শাফায়েত জামিল সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামরার প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সেটা জেনেছি। তাদের সাক্ষ্যে এটা স্পষ্ট যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল নায়ক ও মূল চাবিকাঠি ছিলেন মেজর জিয়া এবং জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকলে বঙ্গবন্ধু হত্যার দায়ে তার সাজা হতো, বিচার হতো। ওনি মরে গিয়ে বেঁচে গেছেন।
সাবেক এ বিচারপতি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে ক্ষমতায় বসেই জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান জয় বাংলাকে দেশান্তরিত করেন। সমস্ত বাংলা শব্দকে দেশান্তরে পাঠান। শাহ আজিজের মতো রাজাকারকে প্রধানমন্ত্রী বানান। তিনি পাগল হয়েছিলেন রাজাকারদের ক্ষমতায় বসানোর জন্য। মুক্তিযোদ্ধা ও তার ক্যাবিনেটের সদস্য ক্যাপ্টেন নূরুল হক তার বইতে লিখে গেছেন, ক্যাপ্টেন তাহেরকে হত্যার জন্য জিয়া পাগল হয়ে গিয়েছিলেন।
নাট্যব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, ড. কামাল স্বাধীনতা কাজে লাগিয়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করেছেন। যদিও তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। তবে বঙ্গবন্ধুর পরামর্শদাতা ছিলেন। লাহোরে জেলেও ছিলেন। পরবর্তীতে বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে ও অসাম্প্রদায়িক নেতা হিসেবে পাকিস্তান থেকে তাকে বঙ্গবন্ধুই ফিরিয়ে এনেছিলেন। খন্দকার মোশতাক আওয়ামী লীগ ছেড়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুই ফিরিয়ে এনেছিলেন। তার মাথায় যে বদবুদ্ধি ছিল তা যে বঙ্গবন্ধু জানতেন না তা নয়, জানতেন। কিন্তু আমরা সর্ষের মধ্যে ভূত তাড়াতে সঙ্কোচবোধ করি। এটা আর করা যাবে না।
বিকল্পধারার প্রেসিডিয়াম সদস্য শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, অপরাজনীতি থেকে দূরে থাকতেই বিএনপি থেকে বেড়িয়ে এসেছি। অপরাজনীতির প্রস্থান ও নতুন অধ্যায় তৈরি করা কোনো ঘটনা নয়, এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে আরও চালিত করতে হবে। শুধু চেতনা নয়, নৈতিক মূল্যবোধ হিসেবে নিতে হবে। তবেই সামনে অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী চেতনার অপশক্তিকে আশ্রয় দিতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের অনেক লড়াকু সৈনিকও হেরে গেলেন গত ৩০ তারিখের নির্বাচনে।
জাগো বাংলা ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী নাসির আহমেদের সভাপতিত্বে আরো বক্তব্য রাখেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির ভিসি অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী, সংগঠনের সদস্য সচিব ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল প্রমুখ।