রাজধানীসহ সারাদেশে খুন, ছিনতাইয়ের মধ্যে চাঁদাবাজরাও বেপরোয়া
বিডিনিউজ
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:০২
![রাজধানীসহ সারাদেশে খুন, ছিনতাইয়ের মধ্যে চাঁদাবাজরাও বেপরোয়া](/assets/news_photos/2025/02/11/image-284232-1739250305bdjournal.jpg)
ঢাকার আদাবরে চাপাতির কোপে বাম হাতের কবজি খুইয়ে সুমন শেখ নামে এক তরুণ অভিযোগ করেছেন 'ছিনতাইয়ের শিকার’ হয়েছেন তিনি। অবশ্য সুমনের কবজি খোয়ানোর ঘটনাকে পুলিশের পক্ষ থেকে দুই অপরাধী দলের ‘দ্বন্দ্বের জের’ বলে দাবি করা হয়েছে। ঘটনা যাই হোক, দিনের বেলায় প্রকাশ্যে এমন ঘটনা ঘটলে পুলিশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঢিলেঢালা চিত্রই তুলে ধরে।
বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) বিকেলের ঘটনায় সুমন শেখ কবজি হারিয়ে বেঁচে গেলেও এর দুদিন আগে ২৮ জানুয়ারি ঢাকার আরেকপ্রান্তে দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সামনে মিনহাজুর রহমান নামে এক তরুণ ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান।
রাজধানীসহ দেশজুড়ে এমন ছুরি বা চাপাতির কোপে হতাহতের ঘটনা ঘটছে প্রতিদিন। ছিনতাই বেড়ে যাওয়ায় ঢাকাবাসীর মনে সন্ধ্যা নামতেই ভয় চেপে বসছে।
নগরীতে প্রায় দেড় যুগ ধরে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসা মো. শেখ চুন্নু বলছিলেন, জানুয়ারিতে ১৫ দিনে কাকরাইল ও পল্টন এলাকায় দুবার তার রিকশা আরোহীরা ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। ফরিদপুরের নগরকান্দা এলাকার বাসিন্দা চুন্নু ঢাকার কামরাঙ্গীচরে রিকশা গ্যারেজেই থাকেন। পঞ্চাশোর্ধ এই রিকশাচালক গণমাধ্যমকে বলছিলেন, ১৭-১৮ বছর ধইরা ঢাকায় দিনে-রাইতে রিকশা চালাই, এত বাজে পরিস্থিতি দেহি নাই। আগেও আছিল চুরি-ছিনতাই, কিন্তু এহন বাইড়া গেছে। “আগে ১৫-২০ দিন কামাইয়ের টাকা পকেটে একলগে কইরা বাড়িত পাঠাইতাম। এহন একবেলার ইনকাম আরেকবেলা লগে নিয়া বাইর অই না। হয় গ্যারেজে রাইখা বাইর হই, নয়তো বাড়িত পাঠাইয়া দেই।”
ছিনতাই আতঙ্কের কথা বলছিলেন বাড্ডা থেকে মতিঝিলে অফিস করতে যাওয়া একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ফিরোজ আহমেদ। কাজ শেষ হতে প্রায়ই রাত হয়ে যাওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, “আগে অফিস থেকে বের হয়ে যানজট দেখলে প্রায়ই হেঁটে আগাতে শুরু করতাম। এখন যে পরিস্থিতি চলছে, চেনাজানা অনেকেই ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন। এখন রিকশা-সিএনজিতে চলাচল করতেও ভয় লাগে।”
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা যাদের ‘প্রধান দায়িত্ব’, সেই পুলিশ সদস্যের ওপরও হামলার ঘটনা ঘটছে দেশের কোথাও কোথাও।
১৪ জানুয়ারি রাতে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও এলাকায় কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় পুলিশের চেকপোস্টে হামলায় এসআই হাবিবুর রহমান ও এএসআই অসিত নাথ, কনস্টেবল আবদুল সাত্তার, আমিরুল ইসলাম ও ফরিদ শেখ আহত হন। পরদিন এই ঘটনায় মোরশেদ খান ও মো. করিম নামে দুজনকে গ্রেপ্তারের পর চট্টগ্রাম মহাননগর পুলিশ-সিএমপির সহকারী কমিশনার (পাঁচলাইশ জোন) আরিফ হোসেন গণমাধ্যমকে বলছিলেন, “গ্রেপ্তার হওয়া দুজন অটোরিকশা নিয়ে বোয়ালখালীর দিক থেকে শহরে আসছিলেন। মোহরা চেকপোস্টে পুলিশ তাদের অটোরিকশাটি তল্লাশির জন্য থামার সংকেত দেয়। এসময় তারা উত্তেজিত হয়ে পুলিশের সাথে বাকবিতণ্ডা শুরু করে এবং এক পর্যায়ে পুলিশকে ধাক্কা দেয় ও বেল্ট দিয়ে মারধর করে।”
দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এমন হামলার আশঙ্কায় সার্বক্ষণিক ‘আতঙ্কিত’ থাকার কথা বললেন পুলিশের কয়েকজন সদস্য। তাদের ভাষায়, পুলিশের জন্য এখন স্বাভাবিক কাজ করা আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে গেছে।
২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টের গণআন্দোলন ও সহিংসতার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পর থেকেই দেশজুড়ে থানাসহ পুলিশের স্থাপনাগুলোতে একের পর এক হামলা হতে থাকে। ভাঙচুর ও লুটপাটও করা হয় অনেক থানায়।
সেই ছত্রভঙ্গ অবস্থা থেকে পুলিশ বাহিনীকে সংগঠিত অবস্থায় ফেরানোর প্রক্রিয়ার মধ্যে সংস্কারের উদ্যোগ চলছে। আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখতে সশস্ত্রবাহিনীর হাতে দেয়া আছে গ্রেপ্তারি ক্ষমতা। যৌথবাহিনীর অভিযান চলছে বেশ আগে থেকেই। এর মধ্যে রোববার থেকে শুরু হয়েছে আরেক যৌথ অভিযান– ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’। অবশ্য একে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার সাধারণ উদ্যোগ বলা যাবে না। সেনা, বিমান ও নৌবাহিনী ছাড়াও পুলিশ, বিজিবি, আনসার, কোস্ট গার্ড সদস্যদের সমন্বয়ে এ অভিযান চালানো হবে বলে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম জানিয়েছেন।
এ অভিযান কাদের বিরুদ্ধে, সেই প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “ডেভিল মানে কী? শয়তানই তো টার্গেট এটায়। যারা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে, যারা আইন অমান্য করে, দুষ্কৃতকারী এবং সন্ত্রাসী, তারাই এটার টার্গেট।”
পরিসংখ্যানে প্রকৃত চিত্র কি আসছে?
সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে স্বস্তি ফেরাতে অন্তর্বর্তী সরকারের নানা উদ্যোগের মধ্যে প্রতিদিনই এমন খুন, ডাকাতি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজি বেড়ে যাওয়ায় দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কথা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ‘অস্বীকার’ করেননি।
তারা বলছেন, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগে পুলিশ যেভাবে ‘অর্গানাইজড’ ছিল এখন তেমনটা নেই। পুলিশ সদস্যদের ‘মনোবল’ এখনও আগের জায়গায় ফিরে আসেনি। তাই আইন-শৃঙ্খলার এমন পরিস্থিতি ‘খুব অস্বাভাবিক’ নয়। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানে বলছে, বিগত বছরের তুলনায় অপরাধ বাড়েনি।
যদিও পরিসংখ্যানে প্রকৃত চিত্র উপস্থাপিত হচ্ছে না মন্তব্য করে অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ‘ধীরে চল’ নীতি যে ঘাটতি তৈরি করেছে, তাতে বেপরোয়া হয়ে উঠছে অপরাধীরা। ধীরে চলার এমন নীতির কারণে ভুক্তভোগীরা সহজে পুলিশের শরণাপন্ন হচ্ছেন না।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়িয়ে ‘জোরালোভাবে’ আইন প্রয়োগ করতে হবে, বলছেন বিশ্লেষকরা।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে সারাদেশে ২০৪টি খুনের মামলা হয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা রেঞ্জে সর্বোচ্চ ৪৫টি ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) আওতাধীন এলাকায় ২৪টি মামলা হয়েছে।
আর ওই মাসে সারাদেশে ১৩ হাজার ৬২২টি মামলার মধ্যে শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরে মামলা হয়েছে ১ হাজার ৫৮৫টি। এর মধ্যে ঢাকায় ছিনতাইয়ের ৩৯টি ঘটনায় মামলার পাশাপাশি ৯টি ডাকাতি, ১৩১টি চুরি ও ৫২৯টি মাদক মামলা হয়েছে। তার আগের মাসে দেশজুড়ে ২১১টি খুনের মামলার মধ্যে সর্বোচ্চ ঢাকা রেঞ্জে ৫৬টি ও ডিএমপিতে ১৩টি মামলা হয়েছে। একই মাসে ১৩ হাজার ৮২৭টি মামলার মধ্যে শুধুমাত্র ঢাকা মহানগরে মামলা হয়েছে ১ হাজার ৩২৪টি। এর মধ্যে ঢাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনায় ২৭টি, চুরির ১২৫টি এবং মাদকের ৪২১টি মামলা হয়েছে। অক্টোবর মাসে ২৪৯ খুনের মামলার মধ্যেও সর্বোচ্চ ঢাকা রেঞ্জে ৬২ ও ডিএমপিতে ২০টি মামলা হয়েছে। ওই মাসজুড়ে সারাদেশে ১৩ হাজার ২৬৫টি মামলার মধ্যে ঢাকা মহানগরে মামলা হয়েছে ১ হাজার ২৪৮টি। এই মাসে ঢাকায় ২০টি ছিনতাই, ৬টি ডাকাতি ও ৯৭টি চুরির মামলা করা হয়েছে।
গত ডিসেম্বরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩২টি খুনে ঘটনা ঘটা চট্টগ্রাম রেঞ্জ মামলার দিকে থেকে শীর্ষে, যেখানে ২ হাজার ১৭০টি মামলা হয়েছে। মহানগর পুলিশের আওতাধীন এলাকাগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ এলাকায় চার খুনসহ মোট মামলা ৩৩৮টি।
নভেম্বরেও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম রেঞ্জে, আর ওই মাসে মামলা হয়েছে ২ হাজার ২৭১টি। ওই মাসে চট্টগ্রাম মহানগরীতে দুই খুনসহ মোট মামলা হয় ৩৭৬টি।
অক্টোবর মাসে ৫২টি খুনের ঘটনায় চট্টগ্রাম রেঞ্জ ছিল দ্বিতীয় অবস্থানে; একইসঙ্গে ওই মাসে মামলার সংখ্যা ২ হাজার ২২৫টি। আর চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায় ছয় খুন নিয়ে মোট মামলা ছিল ৩৫৬টি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ মূহুর্তে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে সারাদেশে ২৩৩টি খুনের ঘটনা নিয়ে মোট মামলা ১৪ হাজার ৪৮৩টি। নভেম্বরে ২২৭টি খুনসহ মোট মামলা ১৩ হাজার ৬৮১টি এবং অক্টোবরে ২৫৮টি খুন ও অন্য অপরাধ মিলিয়ে মোট মামলা ছিল ১৫ হাজার ৯৮৯টি।
সার্বিকভাবে মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলার ‘অবনতির’ কথা বলা হলেও পুলিশের খাতায় থাকা মামলার পরিসংখ্যানে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় অপরাধ কম।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, “সার্বিকভাবে আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থাই এরকমভাবে পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে অস্বীকার করা বা এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। ফলে ভুক্তভোগীরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শরণাপন্ন হতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। এমনটা সব সময়ই হতো, আজকাল বেড়েছে। “চুরি, ছিনতাই বা ব্যবসায়ীদের চাঁদা ও আধিপত্য বিস্তারে হুমকির ক্ষেত্রে অনেকে ব্যাপারগুলোকে এড়িয়ে যান। তাই মামলার সংখ্যার সাথে মানুষ যা বলছে তা তো মিলছে না।”
জামিনে ‘শীর্ষ সন্ত্রাসীরা’, জড়াচ্ছেন অপরাধে
২০ জানুয়ারি ঢাকার পল্লবীতে মঞ্জুরুল ইসলাম ওরফে বাবু নামে এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যার পর পুলিশ জানায়, চিহ্নিত ‘সন্ত্রাসী’ বাবু ‘ব্লেড বাবু’ নামে পরিচিত ছিলেন। আর এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ঢাকার আরেক ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ সুমন শিকদার ওরফে মুসার নাম এসেছে।
২০২২ সালের ২৪ মার্চ মতিঝিলে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত মুসা পালিয়ে গিয়েছিলেন ওমানে। সেখান থেকে ওই বছরেরই ৯ জুন তাকে ফিরিয়ে আনে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। মুসাকে টিপু হত্যার ‘অন্যতম পরিকল্পনাকারী’ বলে অভিহিত করেছিল ডিবি।
ক্ষমতার পালাবদলের পাঁচ মাসের মাথায় গত ৩ জানুয়ারি জামিনে বের হন মুসা, এর কিছুদিন পরেই পল্লবীর হত্যাকাণ্ডে আবারও তার ‘সংশ্লিষ্টতার’ কথা জানায় পুলিশ।
পল্লবী এলাকার আধিপত্য বিস্তারের জেরে শীর্ষ সন্ত্রাসী মফিজুর রহমান ওরফে মামুন গ্রুপের সঙ্গে মুসা গ্রুপের ‘দ্বন্দ্বের’ জেরে খুন হন বাবু। ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত তালিকার ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর দুজন প্রকাশ-বিকাশের সহযোগী ছিলেন মুসা।
বাবু হত্যা মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির মিরপুর বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) সোনাহর আলী শরীফ গণমাধ্যমকে বলেন, “এ হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের দেয়া বিভিন্ন তথ্য যাচাই করে দেখা হচ্ছে।”
গত ১০ জানুয়ারি ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে ‘মাল্টিপ্লান সেন্টারের’ সামনে কম্পিউটার ব্যবসায়ী এহতেসামুল হক ও ওয়াহিদুল হাসান দিপুকে ১০-১২ জনের একটি দল এলোপাতাড়ি কুপিয়ে আহত করে। এ ঘটনায় এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ওয়াহিদুল হাসান দিপু ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমনসহ ১০ জনের নাম উল্লেখ ও অচেনা আরও ২০-২৫ জনকে আসামি করে নিউ মার্কেট থানায় হত্যাচেষ্টার মামলা করেন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, আসামিরা ৫ অগাস্টের পর বিভিন্ন সময়ে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের ব্যবসায়ীদের কাছে চাঁদা দাবি করতেন। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে ব্যবসায়ীদের ভয়-ভীতি ও হুমকি দিত।
ইমন গত ১৬ অগাস্ট জামিনে মুক্তি পান। তার একদিন আগেই দুই যুগ পর জামিনে বের হয়ে আসেন আরেক ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, যিনি গত ১০ জানুয়ারির হামলায় আহত দিপুর আপন ভাই।
এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গত ২৪ জানুয়ারি ঢাকার ৩০০ ফিট এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় ছাত্রদল নেতা মোহাম্মদ হোসাইন মিথুনকে। তাকে নিয়ে নিউ মার্কেট থানার সামনে পৌঁছালে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে তার অর্ধশতাধিক অনুসারী।
পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় পৃথক মামলায় ৭ জনকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ জানিয়েছে, ছাত্রদল নেতা মিথুন সন্ত্রাসী ইমনের অনুসারী। যিনি ইমনের হয়ে ধানমন্ডি এলাকার চাঁদাবাজির অর্থ আদায় করতেন। ইমন বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করলেও এলাকায় ‘আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজিকে’ কেন্দ্র করে পিচ্চি হেলাল ও ইমন গ্রুপের দ্বন্দ্বেরই বহিঃপ্রকাশ মাল্টিপ্লান সেন্টারের সামনের ওই ঘটনা।
নিউ মার্কেট থানার ওসি মোহসিন উদ্দিন বলেন, “মিথুনকে গ্রেপ্তার করে থানায় আনার পর পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায়ও অনেকে পুলিশের জালে রয়েছে।”
এছাড়া, ১৯ বছর পর গত ৩ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পেয়েছেন সরকারের তালিকায় থাকা আরেক ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম। সরকার বদলের পর কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছেন মিরপুরের আব্বাস আলী, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন ও খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু। কারাগারে থেকেই বিভিন্ন এলাকার ‘আন্ডার ওয়ার্ল্ড’ নিয়ন্ত্রণ করে আসা তাদের অনেকেই জামিনে বেরিয়ে পুরো নিয়ন্ত্রণ নিতে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, “আমরা বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাচ্ছি। জেল থেকে বের হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীরা নানা ধরনের অপকর্মে জড়াচ্ছেন। আমরা জামিন বাতিলের জন্য আবেদন করব।”
এ ধরনের অপরাধীদের জামিনের বিষয়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযু্ক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ ওমর ফারুক গণমাধ্যমকে বলেন, “এটাই আমাদের আশঙ্কার বিষয়। আইনগতভাবে যত কথাই বলুক, ঢালাওভাবে জামিন দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
“সামাজিকভাবে জননিরাপত্তায় কী সমস্যা তৈরি হতে পারে যাচাই-বাছাই করে এ ধরনের অপরাধীকে জামিনে মুক্তি দেওয়া উচিত ছিল।”
বেড়েছে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য
গত ১৮ ডিসেম্বর রাতে ঢাকার হানিফ ফ্লাইওভারের ওপর ২৩ বছর বয়সী কামরুল হাসান নামে এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যার ঘটনায় ২০ ডিসেম্বর দুই ‘কিশোর ছিনতাইকারীকে’ গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
ধরা পড়া ১৬ ও ১৭ বছর বয়সী দুইজন ‘পেশাদার’ ছিনতাইকারী বলে পুলিশ জানায়।
ডিএমপি ওয়ারী বিভাগের অতিরিক্ত উপ কমিশনার মফিজুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, “ওই এলাকায় মূলত মাদক সেবনের টাকা জোগাড় করতে তারা ছিনতাই করত। তারা হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার কথা প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছে।”
উঠতি বয়সীদের দলবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়া এসব ‘কিশোর গ্যাং’গুলো আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তারা দল বেঁধে চলাফেরা করে নিজেদের আধিপত্য জানান দেওয়ার পাশাপাশি চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক কারবার এমনকি খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ছে।
অপরাধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা
গেল ২১ জানুয়ারি ঢাকার মগবাজার এলকায় ডাকাতির প্রস্তুতিকালে দুই সেনা সদস্যসহ চারজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় পুলিশ।
বনানী থানার ওসি রাসেল সারোয়ার বলেন, গ্রেপ্তার চারজনের মধ্যে একজন কর্পোরাল ও একজন সৈনিক। তাদেরকে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অন্য দুজনের একজন গাড়ির ড্রাইভার এবং একজন পুলিশের সোর্স।
ওই চারজনের সঙ্গে আরো কয়েকজন ছিল, যারা পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিল।
ওসি বলেন, “তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন পত্রিকার পরিচয়পত্র, মাইক্রোফোন, সেনাবাহিনীর পোশাক, জুতা ও একটি মাইক্রোবাস জব্দ করা হয়েছে।"
দুই সেনা সদস্যের গ্রেপ্তার হওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর-আইএসপিআরের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি উদ দৌলা চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তাদের বিরুদ্ধে সেনা আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
তার আগের দিন ভোরে দুবাই থেকে আসা এক প্রবাসী ঢাকায় নেমে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বাড়ি ফেরার পথে পুলিশ পরিচয়ধারী ‘ডাকাতের’ কবলে পড়ার অভিযোগ করেন। ওই পরিবারের মণিকা সরকার (২৫) নামে একজন ডাকাতের মারধরে আহত হয়ে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাও নিয়েছেন।
ভোর সাড়ে ৪টার দিকে রাজধানীর বিমান বন্দর সড়কের হোটেল র্যাডিসনের সামনে এই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মণিকার স্বামী সনজিৎ সরকার গণমাধ্যমকে বলেন, “বিমানবন্দর থেকে ফরিদপুরে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পথে হোটেল র্যাডিসনের সামনে আমাদের মাইক্রোবাসটিকে পুলিশের মত ‘সিগন্যাল লাইট’ জ্বালিয়ে থামার সংকেত দেওয়া হয়।
“গাড়িটি থামার পর পুলিশের মত পোশাক পরা লোকজন এসে পরিচয় জানতে চান। পরে পাসপোর্ট ও ব্যাগ চান। পাসপোর্ট দিতে অস্বীকার করলে টানা-হেঁচড়া শুরু করেন। এক পর্যায়ে তারা আমাদের মারধর ও গাড়ি থেকে নামানোর চেষ্টা করেন, গাড়িটির কাচ ভাঙচুর করেন। আমাদের চিৎকারে লোকজন এগিয়ে এলে ডাকাতরা মাইক্রোবাসে করে পালিয়ে যায়।”
এর আগে ১৪ জানুয়ারি পুলিশের পোশাক পরে অস্ত্র দেখিয়ে ছিনতাই করার সময় সাবেক এক পুলিশ সদস্যসহ তিনজনকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
হাতিরঝিল থানার ওসি মোহাম্মদ রাজু গণমাধ্যমকে বলেন, “গ্রেপ্তার হওয়া তিন জনের একজন হলেন পুলিশের চাকরি হারানো মো. হাকিম উদ্দিন। ২০২২ সালে চাকরিচ্যুত হন তিনি। গ্রেপ্তারের সময় তাদের কাছ থেকে পুলিশের পোশাক, জুতা ও দুটি মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন জিনিস জব্দ করা হয়।”
গত ১১ অক্টোবর গভীর রাতে সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাক পরে সংঘবদ্ধ ডাকাত দল একটি বাসায় ঢুকে ৭৫ লাখ টাকা ও ৭০ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করেছে মোহাম্মদপুর এলাকায়।
মোহাম্মদপুর থানার ওসি আলী ইফতেখার হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, “এ ঘটনায় ১১ জনকে গ্রেপ্তারসহ ৯ লাখ ২০ হাজার টাকা ও কিছু স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়েছে।”
এদের মধ্যে সেনাবাহিনী ও বিমান বাহিনীর চাকরিচ্যুত পাঁচজন থাকার কথা জানিয়েছিলেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস।
পুলিশের কী করা উচিত আর কী ‘ব্যবস্থা’ নেয়া হচ্ছে?
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তবর্তী সরকার দেশের হাল ধরেছে প্রায় ছয় মাস হল।
আন্দোলনের পর বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে পুলিশকে টহলসহ নিরাপত্তা সব জায়গায় ফেরানোর চেষ্টার মধ্যে আইনশৃঙ্খলার বেহাল দশার বিষয়টি তুলে ধরে অধ্যাপক মুহাম্মদ ওমর ফারুক গণমাধ্যমকে বলেন, “পুলিশ এখন আসলে পরিপূর্ণভাবে সক্রিয় হতে পারছে না। অপরাধীরা এখন বেপরোয়া।”
অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ‘দ্রুততম’ সময়ে আইন প্রয়োগের পরামর্শ দিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, “এখন পুরোনো যারা অপরাধী আছে, তাদের নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, পুলিশের এলাকাভিত্তিক নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি গোয়েন্দা ইউনিটগুলোকে আরও সক্রিয় করতে হবে।”
ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, “আইন-শৃঙ্খলার বিষয়ে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। যাতে অপরাধের সংখ্যা কমে আসে। গত কয়েক মাসের রেশিওতে অপরাধ কমেছে, হয়ত কিছু ক্ষেত্রে মামলার সংখ্যা বেড়েছে। “তবে যে বিষয়গুলো আমাদের নজরে আসছে আমরা সেগুলোকে মামলা হিসেবে রেকর্ড করছি। বিভিন্ন অপরাধে জড়িতদের গ্রেপ্তার করছি। আশা করছি এটি আরও কমে আসবে।”
সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ গণমাধ্যমকে বলেন, “আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমরা নানা ব্যবস্থা নিয়েছি। এর মধ্যে ওপেন হাউজ ডে প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে, প্রিভেন্টিভ অ্যারেস্ট বাড়াতে বলা হয়েছে। সব ধরনের মামলা নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ছিনতাই, মাদক এগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চলছে।”
পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রায় ছয় মাসে পুলিশ সাংগঠনিকভাবে যে অবস্থায় দেখার প্রত্যাশা ছিল, সে অবস্থায় এখনও ফিরেনি বলে স্বীকার করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম।
তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বর্তমান অবস্থাকে খুব ‘অস্বাভাবিক নয়’ মন্তব্য করে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, “একটা বড় ধরনের ঝাঁকি গেছে না সমাজের ওপরে? এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এফেক্টেডতো পুলিশ। ৪৫-৪৬ জনকে তো আমরা রিটায়ার্ডই করিয়ে দিয়েছি। “এজন্য পুরো অর্গানাইজেশনটাই একরকম স্ক্যাটার্ড হয়ে গেছে। তাই বলে যে, আমরা হাত তুলে যে বসে থাকব তা-ও তো না। আমাদের আগের মতই সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এটাই নানানভাবে চাচ্ছি।”
পুলিশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ বসে আছে– সংবাদমাধ্যমের এমন খবরের দিকে ইঙ্গিত করে আইজিপি বলেন, “এখনও দেখি থানার ওসি হইয়া বসে আছে। এগুলো স্ক্রিনিং আউটের কাজটা একটু কঠিন। কিন্তু আমরা একটু একটু করে করছি। আর হচ্ছে এদেরকে মোটিভেট করা।”
রাতের ঢাকার বিষয়ে ‘ডিসটার্বিং রিপোর্ট’ এসেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সেটার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা রাতে মনিটরিং করছি। পেট্রোলগুলা আছে কি না আমার সিনিয়র অফিসাররা মনিটরিং করছেন। “এইভাবে আমরা দেখছি, পেট্রোলগুলো যাতে ঘুমিয়ে না পড়ে। এই কাজগুলাই করার চেষ্টা করছি। এখন একেবারেই যে সব করে ফেলব সেই আশাও করি না। কিন্তু আমরা হাত পা ছেড়ে দিয়ে বসে যাইনি।”
বাংলাদেশ জার্নাল/আরএইচ