একসঙ্গে কাজ করতে ভারতকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার আহ্বান
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৫:৫০
![একসঙ্গে কাজ করতে ভারতকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার আহ্বান](/assets/news_photos/2025/02/06/image-283994-1738835861bdjournal.jpg)
বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলের পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে যে ছন্দপতন ঘটেছে, তা কাটিয়ে উঠে একসঙ্গে কাজ করার জন্য দিল্লির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন।
বৃহস্পতিবার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইনডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, “ইতিবাচক ও বাস্তবসম্মত সহযোগিতা থেকে আমাদের জনগণের জন্য অনেক কিছু অর্জন করা সম্ভব। এই সুযোগ আমাদের হাতছাড়া করা উচিত হবে না।”
‘আসুন একসাথে কাজ করি’ শিরোনামের এই নিবন্ধের শুরুতেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ছন্দপতনের প্রসঙ্গ টেনেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।
তিনি লিখেছেন, “২০২৪ সালের জুলাই-অগাস্টে ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার কাছে মনে হয়, শেখ হাসিনা সরকারের পতন যে আসন্ন ছিল, ভারতীয় প্রশাসন তা ধারণাও করতে পারেনি।”
“তথাপি আমাদের স্মরণ করা দরকার যে, দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং আমি, আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ইতিবাচক দিকগুলোর ওপর ভিত্তি করে কাজ করতে এবং উত্তেজনা ও ভুল বোঝাবুঝির ক্ষেত্রগুলো বাস্তবসম্মতভাবে সমাধান করতে আগ্রহী।”
তৌহিদ হোসেন লিখেছেন, “আমাদের অবস্থান প্রথম থেকেই স্পষ্ট: আমরা ভারতের সঙ্গে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে একটি কার্যকর সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। আমরা আশা করি, ভারতের পক্ষ থেকেও আমাদের এই ইচ্ছার যথাযথ প্রতিফলন ঘটবে। গত ডিসেম্বরে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির ঢাকা সফর ছিল এ বিষয়ে ইতিবাচক একটি পদক্ষেপ।”
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় থেকেই যে দুই দেশের অংশীদারত্বের ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল, সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে উপদেষ্টা লিখেছেন, এই সহযোগিতা অব্যাহত রাখা দুই দেশের জনগণের জন্যই কল্যাণকর হবে।
দুই দেশের সম্পর্কে নানা চ্যালেঞ্জ থাকার পরও সাম্প্রতিক দিনগুলোতে কিছু ‘ইতিবাচক অগ্রগতি’ দেখার কথা নিবন্ধে লিখেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। এ প্রসঙ্গে তিনি দুই দেশে বন্দি থাকা জেলেদের যার যার দেশে ফেরানো এবং নেপালের জলবিদ্যুৎ ভারতের ওপর দিয়ে বাংলাদেশে নিতে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির উদাহরণ দেন।
তৌহিদ হোসেন বলেন, “এই ইতিবাচক পদক্ষেপগুলোর ওপর ভিত্তি করে আমাদের পারস্পরিক অংশীদারত্ব গড়ে তোলা উচিত, যা আমাদের উভয় দেশের জনগণ, অঞ্চল এবং বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের জন্য মঙ্গলজনক হবে।”
আর সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে বাংলাদেশের নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা বন্ধ করার মধ্য দিয়ে সেই সম্পর্ক রচনার একটি ‘ভালো সূচনা’ হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।
সাম্প্রদায়িক হামলা ও ভারতীয় গণমাধ্যমের ভূমিকা
ক্ষমতার পালাবদলের পর বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ নিয়ে আগের মতই ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সমালোচনা করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।
তিনি লিখেছেন, ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আগের সরকারের পতন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বগ্রহণের মধ্যে কয়েক দিনের ব্যবধান ছিল, সে সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে ছিল না। সে সময় কিছু ‘অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা’ ঘটে।
“মূলত আগের সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের ঘিরে সেসব ঘটনা ঘটে। তাদের অধিকাংশ মুসলমান হলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু মানুষও এর শিকার হয়েছিলেন।”
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়া পর এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে ‘কঠোর ব্যবস্থা’ নিয়েছে দাবি করে তৌহিদ বলেন, “হিন্দু পরিবার ও মন্দিরগুলো রক্ষায় দেশের সাধারণ মানুষও সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে এসেছে।
“তবে দুঃখজনকভাবে, ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এ বিষয়ে অতিরঞ্জিত এবং অনেক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রচার করে চলেছে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ধর্মীয় বিশ্বাসের বিচার না করে প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অঙ্গিকারাবদ্ধ। হিন্দুরাও বাংলাদেশের নাগরিক এবং তাদেরও সমান অধিকার রয়েছে।”
ভয়েস অব আমেরিকা পরিচালিত একটি স্বাধীন জরিপের বরাত দিয়ে উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ মনে করে যে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে সংখ্যালঘুরা আগের চেয়ে ‘ভালো’ আছে।
“আমরা দক্ষিণ এশিয়া এবং তার বাইরেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটি মডেল গড়ে তুলতে চাই। আমরা ভারতীয় সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানাই, তারা এখানে এসে কোনো বিধিনিষেধ ছাড়াই স্বাধীনভাবে প্রতিবেদন তৈরি করতে পারেন। তাদের নিরপেক্ষ অনুসন্ধানের মাধ্যমে ভারতের জনগণ সত্যটা জানতে পারবে।”
‘সার্ক নিয়ে ভয়ের কিছু নেই’
উপদেষ্টা লিখেছেন, বিশ শতকের শেষ দশক থেকে ভারত উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। বিশ্বজুড়ে প্রভাব বিস্তারকারী প্রযুক্তি খাতে যেমন তারা সাফল্য পেয়েছে, তেমনি অগ্রগতি হয়েছে অর্থনীতিতেও। ভারত এখন বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি।
এই সময়ে বাংলাদেশও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে মন্তব্য করে তিনি লিখেছেন, বিশ্বে তৈরি পোশাক রপ্তানীতে চীনের পরই এখন বাংলাদেশের অবস্থান। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি অবদান রেখে আসছে।
“নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূসের উদ্ভাবিত ক্ষুদ্রঋণ মডেল বাংলাদেশ থেকে শুরু হয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়েছে এবং ভারতে ব্যাপক আকারে বাস্তবায়িত হয়েছে।”
তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক এক দশকেরও বেশি সময় ধরে অকার্যকর হয়ে রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার সার্ককে কার্যকর করার জন্য ‘আন্তরিক উদ্যোগ’ গ্রহণ করেছে।
“তবে এখন পর্যন্ত ভারতের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া মেলেনি। আমরা মনে করি না এই উদ্যোগ নিয়ে ভারতের ভয় পাওয়ার কিছু আছে।”
উপদেষ্টা লিখেছেন, “আমরা জানি, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে পূর্ণ সহযোগিতা বাস্তবায়ন দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। তবে, হাজার মাইলের যাত্রা একটি ছোট পদক্ষেপে থেকেই শুরু হয়। প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আমাদের নেতৃবৃন্দ কি অন্তত একটি সম্মেলনে একসঙ্গে ছবি তুলে আমাদের দীর্ঘমেয়াদী প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করতে পারেন না?”
বাংলাদেশ জার্নাল/এনবি