সমুদ্র সৈকতে এক মাসে ভেসে এলো ৮৫টি মৃত কচ্ছপ
শফিউল্লাহ শফি, কক্সবাজার
প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২২:৫৫
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে এক মাসে ভেসে এলো ৮৪টি মৃত কচ্ছপ। বর্তমানে চলতি প্রজনন মৌসুমেও সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে মৃত কচ্ছপ ভেসে আসা অব্যাহত রয়েছে। স্থানীয় লোকজন ও গবেষকদের মতে অন্যান্য বছরের তুলনায় এই বছর মৃত কচ্ছপ ভেসে আসার সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।
কক্সবাজারে অবস্থিত সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের দেয়া তথ্য মতে, কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূলে গত দুই দিনে (শনি ও রোব) ভেসে এসেছে ৬৮টি মৃত কচ্ছপ। পাশাপাশি চলতি মাসের শুরু থেকে ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত কক্সবাজারের উপকূলের বিভিন্ন পয়েন্টে ভেসে এসেছে মোট ৮৫টি মৃত কচ্ছপ। একইভাবে গত বছর (২০২৪ সাল) জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি দুই মাসে উপকূলের বিভিন্ন পয়েন্টে ভেসে এসেছিল ২৯টি মৃত কচ্ছপ। এছাড়া উক্ত সময়ে আরো ভেসে এসেছিল ৩টি মৃত ডলফিন, ১টি মৃত পরপইস।
বাংলাদেশ সামুদ্রিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বোরি) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শিমুল ভূঁইয়া দুই দিনে ৬৮টিসহ চলতি মাসের শুরু থেকে ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ৮৫টি মৃত কচ্ছপ ভেসে আসার তথ্য রয়েছে। তিনি জানান, সম্প্রতি সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে মৃত কচ্ছপ পাওয়া যাওয়ার কারনে বোরির একটি গবেষক দল শনিবার সকাল থেকে সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন এলাকায় পরিদর্শনে যান। পাশাপাশি উপকূলের কয়েকটি পয়েন্ট টার্গেট করে কাজ শুরু করেছেন।
এদিকে বোরি থেকে পাওয়া তথ্যমতে, গত ৪ জানুয়ারি সোনারপাড়া সৈকতে ১টি, ৫ জানুয়ারি কক্সবাজার উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় ১০টি, ১০ জানুয়ারি দরিয়ানগর সৈকতে ১টি, ১৮ জানুয়ারি সোনারপাড়া সৈকতে ২টি ও ইনানি সৈকতে ১টি, ২২ জানুয়ারি সেন্টমার্টিন সৈকতে ১টি ও ২৪ জানুয়ারি ইনানী সৈকত এলাকায় ১টি মৃত কাছিম ভেসে আসে।
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শিমুল ভূঁইয়া বলেন, প্রাথমিকভাবে কি কারণে কচ্ছপের মৃত্যু হচ্ছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে বর্তমান সময় হচ্ছে কচ্ছপের প্রজনন মাস। মূলত নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন মৌসুম ধরা হয়। এ সময় বিশেষ করে কচ্ছপ উপকূলে এসে ডিম দেয়।
প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নেকম) উপ-প্রকল্প পরিচালক ড. শফিকুর রহমান বলেন, সামুদ্রিক মা কচ্ছপ এখন মহাবিপদে রয়েছে। তিনি বলেন, মা কচ্ছপের ডিম দেয়ার সময় সাধারণত নভেম্বর থেকে শুরু হয়। চলে এপ্রিল ও মে পর্যন্ত। তারা রাতের বেলায় নির্জন উপকূলে এসে গর্ত তৈরি করে ডিম দেয়। সাধারণত একটি মা কচ্ছপ ৩০টি পর্যন্ত ডিম দেয়। ডিম দেয়া শেষ করে তা মাটি, বালি বা অন্য কোনো জৈব পদার্থ দিয়ে ঢেকে দেয়। এরপর মা কচ্ছপ ফিরে যায় সাগরে। ৬০ থেকে ৭০ দিনের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে ডিম থেকে বাচ্চা জন্ম নেয়। এরপর বাচ্চাগুলো গর্ত থেকে বের হয়ে ফিরে যায় সাগরে।
পরিবেশ বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপলের প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, প্রতি বছর প্রজনন মৌসুমে মৃত কচ্ছপ পাওয়া যাচ্ছে। এসব কচ্ছপের শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকে। সাগরে পুঁতে রাখা মাছ ধরার জালে আটকা পড়লে জেলেরা লাঠিসোটা দিয়ে পিটিয়ে কিংবা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে কচ্ছপকে হত্যা করে সমুদ্রে নিক্ষেপ করে। জোয়ারের পানিতে কচ্ছপগুলো উপকূলে ভেসে এলে কুকুর খেয়ে ফেলেছে। জেলেদের সচেতন করা, ডিম দেওয়ার স্থানটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি এবং সৈকতে কুকুরের বিচরণ রোধ করা জরুরি। তা না হলে কচ্ছপ রক্ষা করা যাবে না।
একইভাবে নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্টের (নেকম) প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন ব্যবস্থাপক আবদুল কাইয়ুম বলেন, নির্জন সৈকতে কচ্ছপ ডিম দিতে আসে। নানা কারণে ডিম দেওয়ার স্থানগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পর্যটনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি কক্সবাজার সৈকতে আলোকায়ন, সমুদ্রে পরিত্যক্ত জাল ফেলে দেয়া, ডিম ছাড়ার মৌসুমে বিচে ডাইভিং, খেলাধুলা, সৈকতে হাঁটা ইত্যাদি কচ্ছপের ডিম দেয়ার পরিবেশ নষ্ট করেছে। ক্রমাগত কচ্ছপের ডিম দেয়ার স্থান কমছে।
বাংলাদেশ জার্নাল/এমপি