ময়মনসিংহে কাওয়ালি অনুষ্ঠানে হামলা, ২০০ বছরের পুরোনো মাজারে ভাঙচুর
এলাকায় আতঙ্ক, তীব্র সমালোচনা
প্রতিনিধি
প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮:২৩ আপডেট : ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১৮:৫৫
ময়মনসিংহ শহরের প্রাণকেন্দ্রে হযরত শাহ সুফি সৈয়দ কালু শাহ (রাঃ)-এর মাজারে মিলাদ মাহফিল, দোয়া ও সামা কাওয়ালি অনুষ্ঠান হামলা করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এরপর গভীর রাতে কয়েকশ মাদ্রাসা ছাত্র গিয়ে হামলা চালিয়ে ২০০ বছরের পুরনো মাজারটির একটি অংশও ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে।
বুধবার রাতে এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন শহরের রাজনৈতিক নেতা, সংস্কৃতিকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও। এ ঘটনায় শহরে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বুধবার রাত ১১টার দিকে নগরীর থানার ঘাট এলাকায় অনুষ্ঠান চলাকালে কাছের জামিয়া ফয়জুর রহমান রহ: মোমেনশাহী বড় মসজিদ মাদ্রাসার কয়েকশ ছাত্র গিয়ে সামা কাওয়ালি অনুষ্ঠানে হামলা চালায়। শিল্পীরা সেখান থেকে সরে গিয়ে প্রাণে রক্ষা পান।
ছাত্ররা মঞ্চ, শামিয়ানা, চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করে। এ সময় বাধা দিতে এসে ছাত্রদের মারধরে কয়েকজন আহত হয়। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। গানের অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
এরপর রাত ৩টার দিকে মাদ্রাসা ছাত্ররা গিয়ে মাজারে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। তখন অবশ্য সেখানে খুব বেশি মানুষ ছিল না। ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের পর ছাত্ররা চলে যায়। বৃহস্পতিবার সকালে খবর পেয়ে সেখানে জড়ো হতে থাকেন ভক্ত-আশেকানরা। একেবারে থানার ঠিক উল্টো দিকে এ ধরনের হামলার ঘটনায় তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
হযরত শাহ সুফি সৈয়দ কালু শাহ (রাঃ)-এর মাজারের পীরবাবা খলিলুর রহমান চিশতী নিজামী বলেন, “বুধবার হযরত শাহ সুফি সৈয়দ কালু শাহ (রাঃ)-এর ১৭৯তম ওরস উপলক্ষে মাগরিবের পর মিলাদ করা হয়। মিলাদ শেষে ঠিক থানা গেটের সামনে শামিয়ানা টানিয়ে সামা গানের আয়োজন করা হয়। সেখানে অনেক ভক্ত আশেকান জড়ো হয়।
“রাত ১১টার দিকে ওসি সাহেব এসে তাড়াহুড়া করে গান-বাজনা বন্ধ করতে বলেন। তাৎক্ষণিকভাবে সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকশ মাদ্রাসা ছাত্র এসে সব ভেঙে চুরমার করে দেয়। তারপর তারা চলে যায়।”
কিন্তু রাত ৩টার দিকে ছাত্ররা আবার এসে মাজারে হামলা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বলে জানান খলিলুর রহমান চিশতী।
তিনি বলেন, “আমরা খুব সুখে ছিলাম, দেড়শ বছরের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটেনি। আমরা এখানে অন্যায় কিছু করিনি। তারা এসব না ভেঙে বললেই পারত, আমরা সবকিছু বন্ধ করে দিতাম। এখন বিচার চাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো করণীয় নেই। সঠিক বিচার হোক, এটাই আমাদের চাওয়া।”
মাজারের উৎসব আয়োজক আলম চিশতী বলেন, “দীর্ঘ বছর ধরে আমরা সামা কাওয়ালি অনুষ্ঠান করে আসছি। ওসি সাহেব যখন বললেন অনুষ্ঠান বন্ধ করার জন্য তখনি আমরা বন্ধ করে দেই। তারপরে কেন হামলা ভাঙচুর চালিয়ে লুটপাট করা হল?
“থানার সামনে আমাদের ওপর এমন ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। আল্লাহর ওলি- আওলিয়ারাই মানুষকে দ্বীন ও ধর্মের দাওয়াত দিয়েছেন। আমরা তো কোনো ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড করিনি। তাহলে আমাদের ওপর এমন হামলা কেন?”
বাউল শিল্পী মিজান বাউলা দীর্ঘদিন ধরে এখানে বাৎসরিক উৎসবে গান পরিবেশন করেন। সঙ্গে তার সহযোগীরাও আসেন। কিন্তু কোনোদিন তিনি এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি।
তিনি হতাশার সঙ্গে বলছিলেন, “৪৫ বছর ধরে হযরত শাহ সুফি সৈয়দ কালু শাহ (রাঃ)-এর মিলাদ মাহফিল, দোয়া ও সামা কাওয়ালি অনুষ্ঠান হয়ে আসছে। কোনোদিন এমন হয়নি। আমি যখন ইসলামিক গান পরিবেশন করছি তখন বড় মসজিদ মাদ্রাসার একদল হুজুর এসে হামলা ভাঙচুর শুরু করে। আমাদের দু-তিনজন আহত হয়। ভাঙচুর করা হয় প্লাস্টিকের চেয়ার, সাউন্ড সিস্টেম, মঞ্চ।
“এ ঘটনায় আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি। থানার সামনে এমন ঘটনা কখনো কাম্য ছিল না। পরে মাজারেও হামলা হয়েছে, প্রশাসন বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিলে এমন ঘটনা আরও বাড়বে সমাজে।”
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জামিয়া ফয়জুর রহমান রহ: মোমেনশাহী বড় মসজিদ মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক শহীদুল ইসলাম বলেন, “ছাত্ররা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে পড়াশোনায় মনযোগী। তারা রাত ১টা পর্যন্ত পড়াশোনা করে। থানার গেইটের সামনে উচ্চ শব্দে গান-বাজনা ও মেয়েদের নাচ হচ্ছিল। তা কানে আসায় শিক্ষার্থীরা মেনে নিতে পারেনি।
“পরে কয়েকজন শিক্ষার্থী গিয়ে তা বন্ধ করে দেয়। বন্ধ করে দিয়ে আসার সময় দুই-একজন শিক্ষার্থীকে স্থানীয়রা মারধর করে হুমকি দিয়েছিল। পরে রাগে-ক্ষোভে শিক্ষার্থীরা মাজারেও কিছুটা ভাঙচুর করেছে, তবে সে বিষয়টি আমি সকালে অবগত হয়েছি। আমরা শিক্ষার্থীদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করছি, এমন ঘটনায় যেন তারা আর জড়িত না হয়।”
কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি শফিকুল ইসলাম খান বলেন, “জামিয়া ফয়জুর রহমান রহ: মোমেনশাহী বড় মসজিদ মাদ্রাসার ছাত্ররা কাওয়ালি অনুষ্ঠানে ভাঙচুর করে। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। চেয়ার, মঞ্চ ভাঙচুর করা হলেও কেউ আহত হয়নি।
“পরে আবার রাত ৩টার দিকে গিয়ে ছাত্ররা মাজারে ভাঙচুর করেছে। এখন পর্যন্ত কেউ কোনো অভিযোগ দেয়নি। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।”
মাজারে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব হয়েছেন অনেকেই। তারা এমন ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
কাওয়ালি অনুষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনা ফেইসবুকে লাইভ করেন তরুণ কবি শামীম আশরাফ। তিনি বলেন, “শিল্প-সংস্কৃতির এই নগরীতে এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। যে যার মতাদর্শে চলবে সেটাই স্বাভাবিক হওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি। সেখানে হামলা-ভাঙচুর কোনো সমাধান হতে পারে না।”
ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক আবুল কালাম আল আজাদ বলেন, “রাত থেকেই আমরা বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব রয়েছি। হামলা চালিয়ে অনুষ্ঠান পণ্ড করার পর মাজারে ভাঙচুর করাটা ঠিক হয়নি।
“এটি অমানবিক হয়েছে। আপনার মতের বিরুদ্ধ হলে প্রতিবাদ করতে পারেন, সেখানে হামলা চালাতে পারেন না। এতে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়, তা কখনই কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না।”
জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির আব্দুল করিম বলেন, “ঘটনাটি অত্যন্ত নিন্দনীয়। সেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা চাই না, এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক ময়মনসিংহ শহরে।”
ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আলমগীর মাহমুদ আলম বলেন, “আমি ঢাকায় রয়েছি, সামা কাওয়ালি অনুষ্ঠানে কে বা কারা হামলা চালিয়েছে শুনেছি। তবে এমনটি হয়ে থাকলে তা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। আশা রাখছি, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার লক্ষ্যে প্রশাসন গুরুত্ব দিয়ে কাজ করবে।”
বাংলাদেশ জার্নাল/এনবি