এবার দুদকের জালে খোদ দুদকের সাবেক কমিশনার
জার্নাল ডেস্ক
প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২:২৯
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) শীর্ষ এক কর্মকর্তা ধরা পড়ছেন দুদকেরই জালে। তিনি হলেন সদ্য পদত্যাগ করা কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক। এরই মধ্যে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বেশুমার দুর্নীতি, অনিয়ম, সরকারি প্লট জালিয়াতি, ক্ষমতার ভয়াবহ অপব্যবহার ও সরকারি গাড়ি ড্রাইভারসহ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। শিগগির তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান দল গঠন করবে কমিশন। এরই মধ্যে দৈনন্দিন অভিযোগ যাচাই-বাছাই সেল (যাবাক) থেকে তার নথি কমিশনে উপস্থাপন করা হয়েছে। গতকাল কমিশন সভায় তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের বিষয়ে অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার তার বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা জানিয়েছেন দুদকের ঊধ্বর্তন দুজন কর্মকর্তা। তাদের একজন বলেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার বারুদ্ধে অনুসন্ধান শুরুর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।
দুদকের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত কমিশনার পদমর্যাদার কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হল। এর আগে দুদকের কোনো সাবেক বা বর্তমান কমিশনারকে দুর্নীতি বা অবৈধ সম্পদের অভিযোগে অনুসন্ধানের মুখোমুখি হতে হয়নি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে জহুরুলের পাসপোর্ট বাতিল করে তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে।
সাবেক জেলা ও দায়রা জজ জহুরুল হক বিডিআর হত্যা মামলার বিচারক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালে তিনি অবসরে যান। আওয়ামী লীগ সরকার তাকে বিটিআরসির কমিশনার এবং পরে চেয়ারম্যান করে।
২০২১ সালের ১০ মার্চ কমিশনার হিসাবে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) যোগ দেন জহুরুল হক। ক্ষমতার পালাবদলের পর গত ৩০ অক্টোবর তিনি পদত্যাগ করেন।
জহুরুল হক ও তার স্ত্রী মাসুমা বেগমের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা নিয়ম ভেঙে দুটি প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। পরে আবার ওই দুটি প্লট ফিরিয়ে দিয়ে নিজেদের ‘ভূমিহীন’ দেখিয়ে নিয়েছেন ১০ কাঠার ‘এখনই বাড়ি করার উপযোগী’ একটি প্লট।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ‘সরকারি চাকুরিজীবী’ ক্যাটাগরিতে পাঁচ কাঠার দুটি প্লট বরাদ্দ নিয়েছিলেন তারা। পরে এই দুটি প্লট ফিরিয়ে দেওয়ার পর একই প্রকল্পের ২৫ নম্বর সেক্টরের ২০৬ নম্বর রোডের ৪৭ নম্বর প্লটটি বুঝিয়ে দেওয়া হয় তাদের। সেখানে বাড়ি নির্মাণের জন্য নকশার অনুমোদনও নেন দুদকের সাবেক এই কমিশনার।
রাজউকের প্লট বরাদ্দ নীতিমালায় ঢাকায় নিজ নামে বা স্ত্রী বা স্বামীর নামে কর্তৃপক্ষের কোনো ভূমি বা আবাসিক প্লট বরাদ্দ পেয়ে থাকলে তিনি নতুন করে কোন বরাদ্দ পাবেন না। তবে এই নিয়ম ‘লঙ্ঘন করে’ জহুরুল হক ও তার স্ত্রী পৃথকভাবে পাঁচ কাঠার দুটি প্লট নেন। সেই পাঁচ কাঠার দুটি প্লটের আয়তনের সমান এখনই বাড়ি করার উপযোগী একটি ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দের আবদারও মিটিয়েছে রাজউক।
২০২২ সালের ২৩ অগাস্ট জহুরুল হক পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের দুটি প্লটের পরিবর্তে একটি ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দের জন্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করেন। মন্ত্রণালয় থেকে আবেদনটি সচিবের মাধ্যমে রাজউকে পাঠানো হয়।
জহুরুল তার আবেদনে পূর্বাচলে পাঁচ কাঠার প্লটের কিস্তি সম্পূর্ণভাবে পরিশোধ করেছেন বলে জানান। তার স্ত্রীও একই প্রকল্পে একটি প্লটের মালিক। তিনি ও তার স্ত্রীর নামে পৃথক পৃথকভাবে পূর্বে বরাদ্দ করা পাঁচ কাঠার দুটি প্লট সমর্পণ সাপেক্ষে রাজউকের যে কোনো প্রকল্পে ১০ কাঠা আয়তনের একটি প্লট বরাদ্দ চান।
জহুরুল তার আবেদনে একটি প্রত্যয়নপত্র দাখিল করেন। ওই আবেদনে তিনি বলেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে পাঁচ কাঠা আয়তনের একটি প্লট সরকারি ক্যাটাগরিতে বরাদ্দ পেয়ে যথাসময়ে সমুদয় কিস্তি পরিশোধ করেছেন। তার স্ত্রী মাছুদা বেগমের নামে একই প্রকল্পে সরকারি ক্যাটাগরিতে বরাদ্দকৃত পাঁচ কাঠা আয়তনের প্লটের আয়তন বৃদ্ধি করে ‘এখনই বাড়ি করার উপযোগী’ ১০ কাঠা আয়তনের একটি আবাসিক প্লট একই প্রকল্পে বরাদ্দ চান। এক্ষেত্রে তার এবং তার স্ত্রীর নামে বরাদ্দ প্লট সমর্পণ করতে উভয়ের কোনো আপত্তি থাকবে না বলেও প্রত্যয়নপত্রে উল্লেখ করেন।
রাজউকের সংশ্লিষ্ট নথিতে বলা হয়, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের প্লটটি জহুরুল ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দখল বুঝে নেন এবং ২০১৪ সালের ৩০ জুন লিজ দলিল রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করেন। অপরদিকে তার স্ত্রী মাসুমা বেগমের নামে বরাদ্দকৃত প্লটটি ২০১৩ সালের ১০ এপ্রিল দখল বুঝে নেন এবং ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি লিজ দলিল রেজিস্ট্রি করে নেন।
পৃথক পৃথকভাবে বরাদ্দকৃত পাঁচ কাঠা আয়তনের দুটি প্লটের পরিবর্তে ১০ কাঠা আয়তনের প্লট বরাদ্দের আবেদনের বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যানের অনুমোদনের জন্য ২০২২ সালের ৮ ডিসেম্বর বোর্ডসভায় উপস্থাপন করা হলে সেটি অনুমোদন দেয়া হয়।
রাজউক ১৯৬৯ সালের বিধিমালা অনুযায়ী সব আবাসিক প্রকল্পে প্লট বরাদ্দ দিয়ে থাকে। প্রতিটি প্রকল্পের জন্য বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আবেদন আহ্বান করা হয়, যা যাচাই-বাছাই শেষে যোগ্যদের বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০২৪ সালের ২৮ এপ্রিল বিধিমালায় সর্বশেষ সংশোধন আনা হয়েছে।
পূর্বাচল আবাসিক প্রকল্পে ২০০২ সালে প্লট বরাদ্দের আবেদন আহ্বান করা হলেও স্বামী-স্ত্রীর যৌথ আবেদনের বিষয়টি সুস্পষ্ট ছিল না, যার ফলে অনেক দম্পতি আবেদন করেছিলেন। ২০০৯ সালে নীতিমালা সংশোধন করে বলা হয়, ঢাকার রাজউক এলাকায় যাদের নামে জমি বা বাড়ি রয়েছে, তারা নতুন করে পূর্বাচলে প্লট পাবেন না। আগে যারা স্বামী-স্ত্রী পৃথকভাবে প্লট পেয়েছেন, তাদের একজনের প্লট বহাল রেখে অন্যজনেরটি সমর্পণ করতে বলা হয়।
২০১০ সালের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কিছু দম্পতি প্লট ফেরত দেন এবং টাকা বুঝে নেন। কিছু ক্ষেত্রে রাজউক নিজেই একটি প্লট বাতিল করে। তবে দুদকের সাবেক কমিশনারের ক্ষেত্রে এর কোনটিই হয়নি।
প্লট নেয়ার ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর গত নভেম্বরে জহুরুল হকের কাছে এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানতে চেয়েছিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
জবাবে তিনি বলেছিলেন, “আমরা যখন প্লট বরাদ্দ নিয়েছিলাম তখন এরকম কোনো নিয়ম ছিল না। পরে আমরা দুটি প্লট স্যারেন্ডার করে ভূমিহীন হয়ে যাই এবং আমি একটি ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ চাই। সেই অনুযায়ী এই প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়, এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি।”
এক্ষেত্রে কী অনিয়ম হয়েছে জানতে চাইলে রাজউকে দীর্ঘদিন কাজ করা একজন কর্মকর্তা বলেন, “নতুন বিধিমালা কার্যকর হয়েছে ২০২৪ সালে। এর আগেই দুদকের কমিশনার দুটো প্লট পেয়েছেন, সে কারণে নতুন বিধিমালা তার ক্ষেত্রে কার্যকর হবে না। সে কারণে দুদক কমিশনারের দুটো প্লট নেয়া বিধিমালা বহির্ভূত।”
সূত্র: বিডিনিউজ।
বাংলাদেশ জার্নাল/এমপি