সামিট পাওয়ারকে আয়কর অব্যাহতি, গচ্চা ১১১২ কোটি টাকা
জার্নাল ডেস্ক
প্রকাশ : ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:০৫
আইনের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি সামিট পাওয়ারকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিধিবহির্র্ভূত সুবিধা দেয়ায় এক হাজার ১১২ কোটি টাকা আয়কর গচ্চা গেছে।
এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) তদন্তে বিধিবহির্ভূতভাবে এই সুবিধা দেয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। তৎকালীন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের চাপে প্রতিষ্ঠানটিকে কর রেয়াত সুবিধা দিতে আদেশ জারি করতে বাধ্য হন আয়কর কর্মকর্তারা।
সাত করবর্ষ ধরে লভ্যাংশ হস্তান্তরের সময় উৎসে কর না কাটায় তা এখন জরিমানাসহ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১১২ কোটি টাকা; যা ‘ফাঁকি’ দেও হয়েছে বলে দাবি সরকারের প্রধান রাজস্ব আদায়কারী সংস্থাটির সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি)।
এনবিআরের একাধিক আয়কর কর্মকর্তা বলেন, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের একান্ত আগ্রহের কারণে সামিট পাওয়ারকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় এবং চেয়ারম্যানের ভয়ে এ বিষয় নিয়ে তৎকালীন কোনো কর্মকর্তা প্রশ্ন করার সাহস পাননি। এই ঘটনাকে আইনের ফাঁক গলিয়ে বড় অঙ্কের আয়কর ফাঁকির সুযোগ করে দেয়ার স্ক্যান্ডাল বলে অভিহিত করছেন কর কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশের সঙ্গে সিঙ্গাপুরের দ্বৈত কর পরিহার চুক্তি আছে। এই চুক্তির অধীনে লভ্যাংশের ওপর ১৫ শতাংশ উৎসে কর কর্তনের বিধান রয়েছে। সাধারণ বাংলাদেশি কোম্পানির ক্ষেত্রে লভ্যাংশের ওপর ২০ শতাংশ কর ধার্য আছে। সিআইসির তদন্তে এই অসঙ্গতি ধরা পড়ায় আয়কর নীতি উইং সম্প্রতি আগের স্পষ্টীকরণ দুটি বাতিল করেছে। একইসঙ্গে নতুন একটি স্পষ্টীকরণ জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, সামিট করপোরেশনকে লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে সামিট পাওয়ার লিমিটেডকে ২০ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন করতে হবে। একইসঙ্গে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে দ্বৈত কর পরিহার চুক্তির আওতায় সিঙ্গাপুরভিত্তিক অনিবাসী (বিদেশি) কোম্পানি সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালকে লভ্যাংশ প্রদানের ক্ষেত্রে সামিট করপোরেশনকে ১৫ শতাংশ উৎসে কর কর্তন করতে হবে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশি কোম্পানি সামিট পাওয়ার লিমিটেডের মালিকানা সামিট করপোরেশন লিমিটেড (৬৩.১৯%), ইউরোহাব ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড (৩.৬৫%), প্রাতিষ্ঠানিক (১৮.৫২%) ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের (১৪.৬৪ শতাংশ) হাতে ছিল। এর মধ্যে সামিট করপোরেশন লিমিটেডের মোট শেয়ার হোল্ডিংয়ের মধ্যে ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ মালিকানা ছিল সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের কাছে। সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানি। সামিট পাওয়ার লভ্যাংশ বিতরণকালে অন্যসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে উৎসে কর আদায় করলেও সামিট করপোরেশনের কাছ থেকে আদায় করেনি।
গত বছরের ১ জুলাই প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এনবিআর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবসা আয়কে (উৎপাদনের তারিখ থেকে পরবর্তী ১৫ বছর) এবং কোম্পানির শেয়ার বিক্রি থেকে উদ্ভূত মূলধনী আয়কে করমুক্ত ঘোষণা দেয়। এছাড়া বিদ্যুৎ কোম্পানিতে কর্মরত বিদেশি ব্যক্তিদের উপার্জিত অর্থ ৩ বছরের জন্য করমুক্ত ঘোষণা দেয়া হয়। একইসঙ্গে বিদ্যুৎ কোম্পানির বৈদেশিক ঋণের সুদ, কোম্পানির প্রদেয় রয়্যালটি, টেকনিক্যাল নো হাউ ফি ও টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ফির ওপর কর অব্যাহতি দেওয়া হয়। কোম্পানির লভ্যাংশ বিতরণের ওপর কর অব্যাহতি দেয়া হয়নি। অথচ ৪ জানুয়ারি ও ১ অক্টোবর বিধিবহির্ভূতভাবে দুটি স্পষ্টীকরণের মাধ্যমে এনবিআর সামিট পাওয়ার থেকে সামিট ইন্টারন্যাশনাল লভ্যাংশ দেয়ার ক্ষেত্রে আয়কর অব্যাহতি দেয়া হয়।
সিআইসির কর্মকর্তারা বলছেন, সামিট পাওয়ার লিমিটেড থেকে সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালকে (সিঙ্গাপুরের কোম্পানি) লভ্যাংশ দেয়া হয়নি। লভ্যাংশ দেয়া হয়েছে সামিট করপোরেশনকে। এক্ষেত্রে ২০ শতাংশ উৎসে কর কর্তন করার বিধান থাকলেও সামিট পাওয়ার লিমিটেড উৎসে কর কর্তন করেনি। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮-১৯ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ৬ বছরে এক হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা লভ্যাংশ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী ৩১৮ কোটি টাকা উৎসে কর কর্তন করেনি প্রতিষ্ঠানটি, জরিমানাসহ যার অঙ্ক ৪৬৫ কোটি টাকা।
অন্যদিকে সামিট করপোরেশন ২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ৫ অর্থবছরে ২ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা লভ্যাংশ গ্রহণ করে। যেহেতু সামিট করপোরেশনের ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ মালিকানা সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল, সেহেতু লভ্যাংশ প্রদানের সময় সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের কাছ থেকে সামিট করপোরেশনের ১৫ শতাংশ উৎসে কর কর্তন করার বিধান ছিল। কিন্তু এনবিআরের স্পষ্টীকরণের কারণে সেই কর কর্তন করেনি সামিট করপোরেশন।
বড় অঙ্কের উৎসে কর ‘ফাঁকি’র বিষয়ে বক্তব্য জানতে সামিট গ্রুপ ও সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান আজিজ খানের হোয়্যাটসঅ্যাপে কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। মেসেজে পাঠানো প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। তবে সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের জনসংযোগ বিভাগ থেকে পাঠানো বিবৃতিতে দাবি করা হয়, তাদের কোম্পানি কখনও কোনো কর ফাঁকি দেয়নি। আমরা এখনো এনবিআর বা কর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো তথ্য পাইনি।
আনুষ্ঠানিক চিঠি পাওয়ার পর এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা তুলে ধরে বিবৃতিতে বলা হয়, তারপর বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী যা করা দরকার আমরা তা করব। আমরা সবসময় আইন মেনে চলেছি এবং চলব।
সামিট গ্রুপের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দুটি কোম্পানির কাছ থেকে বড় অঙ্কের এ রাজস্ব আদায়ে এখন পদক্ষেপ নেবে সিআইসি, যেটিকে দেশের ‘সবচেয়ে বড় উৎসে কর ফাঁকি’ হিসেবে মন্তব্য করে ঢাকার কর অঞ্চল-২ এর কমিশনার মুতাসিম বিল্লাহ ফারুকী বলেন, আমরা এখন কালেকশনে যাব। এনবিআর চেয়ারম্যানের নির্দেশনা রয়েছে, আমরা কালেকশনে যাব। কালেকশনের যে পদ্ধতিগুলো রয়েছে, দ্যাট উইল বি অ্যাপ্লাইড।
প্রসঙ্গত, সামিট গ্রুপের পাশাপাশি সিঙ্গাপুরে তালিকাভুক্ত সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান আজিজ খান। তিনি সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীদের একজন। সরকার পতনের পর তার এবং তার পরিবারের ১১ জন সদস্যের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করা হয়েছে বাংলাদেশে।
সূত্র: বিডি নিউজ ও যুগান্তর
বাংলাদেশ জার্নাল/কেএইচ