ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ আপডেট : ১ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

নদীর পানি কমে যাচ্ছে, ভবিষ্যৎ কী

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১৪  
আপডেট :
 ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:১৭

নদীর পানি কমে যাচ্ছে, ভবিষ্যৎ কী
ছবি: বিবিসি

গত তিন দশকে দেশের প্রধান নদীগুলোর পানিপ্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। আর এ সময়ে বেশিভাগ নদীতে বর্ষা ও বর্ষার আগে-পরে পানিপ্রবাহ কমেছে। এছাড়াও নদীর ওপর বাঁধসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণের ফলে একদিকে মাছের প্রজাতি সঙ্কটের মুখে পড়েছে, অন্যদিকে ম্যানগ্রোভ ফরেস্টে বেড়েছে পানির লবণাক্ততা।

সম্প্রতি বাংলাদেশের নদী নিয়ে আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে।

দেশের ১০টি প্রধান নদীকে নিয়ে করা গবেষণাটিতে দেখা গেছে, গঙ্গা (শুকনো মৌসুমে), গড়াই, হালদা এবং পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের পানি নিরাপদ সীমা পেরিয়ে গেছে। আর অন্য ছয়টি নদী ‘সতর্কতা’ অবস্থানে রয়েছে।

গবেষকরা বলছেন, ‘দ্বিপক্ষীয় চুক্তি থাকা সত্ত্বেও পদ্মার মতো গুরুত্বপূর্ণ নদীর ক্ষেত্রে ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর থেকে শুকনো মৌসুমে ন্যূনতম পানিপ্রবাহ ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।’ একইসাথে ন্যূনতম পানি প্রবাহ না থাকা বা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকার ক্ষতিকারক প্রভাব দেশের বিভিন্ন নদী অববাহিকায় লক্ষ্য করা গেছে।

‘সেফ অপারেটিং স্পেস’ বা নিরাপদ পানিসীমা কী?

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘আইওপি সায়েন্স’এ ‘আ সেইফ অপারেটিং স্পেস ফর দ্য মেজর রিভার্স ইন দ্য বাংলাদেশ ডেল্টা’ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, দেশের ১০টি প্রধান নদীর চারটিই ‘সেফ অপারেটিং স্পেস’ বা নিরাপদ সীমা অতিক্রম করেছে। আর এসব নদীর ৬০ থেকে ৮০ শতাংশেরই পানি প্রবাহের পরিবর্তন হয়েছে।

ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগোর সোশ্যাল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সাসটেইনেবিলিটির সহযোগী অধ্যাপক মো: সারওয়ার হোসেনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আলমগীর কবির ও মো: মাহমুদুল হাসান, পরিবেশবাদী সংগঠন রিভাইন পিপলের শেখ রোকোনুজ্জামান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসান মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ এই গবেষণাটি পরিচালনা করেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, সেফ অপারেটিং স্পেস (এসওএস) বা নিরাপদ পানিসীমা কী?

গবেষকরা বলছেন, একটি নদী ন্যূনতম পানি পাচ্ছে কি না, সেটিই ওই নদীর সেফ অপারেটিং স্পেস (এসওএস) বা নিরাপদ পানিসীমা। গবেষণাটিতে বাংলাদেশের পদ্মা, গড়াই, হালদা, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, তিস্তা, আত্রাই, সুরমা, কুশিয়ারা, ইছামতী- এই ১০টি নদীর পানিসীমা মাপা হয়েছে।

আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটি নদীর প্রায় ৩০ থেকে ৮০ বছরের ঐতিহাসিক উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে ন্যূনতম পানির ভিত্তিতে নদীগুলোকে তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো সেফ বা নিরাপদ, কশাস বা সতর্কতা এবং ডেঞ্জারাস বা বিপজ্জনক।

এর মধ্যে যেসব নদী ন্যূনতম পানি পাচ্ছে না তাকে বিপজ্জনক ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেমন শুকনো মৌসুমের গঙ্গা, গড়াই, হালদা এবং পুরাতন ব্রহ্মপুত্র। আর যেসব নদী ন্যূনতম পানি পাচ্ছে কিন্তু তার পানির প্রবাহে ২০ শতাংশের বেশি পরিবর্তন হয়েছে, সেটাকে বলা হয়েছে সতর্কতা অবস্থা। যমুনা, তিস্তা, আত্রাই, সুরমা, কুশিয়ারা, ইছামতী- এই ছয়টি নদী সতর্কতা অবস্থায় আছে।

আর সবশেষে আছে নিরাপদ ক্যাটাগরি। যেসব নদী ন্যূনতম পানি পাচ্ছে, সেগুলো এই ক্যাটাগরিতে পড়বে। তবে বাংলাদেশের প্রধান ১০টি নদীর কোনোটিই এর অন্তর্ভুক্ত না।

‘নদীর প্রবাহ কমছে’

গবেষক আলমগীর কবির জানান, নদীগুলো নিয়ে প্রাপ্ত উপাত্তের ভিত্তিতে গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে পদ্মা নদীর ৮০ বছরের, আবার কোনো নদীর ৩০ বছরের উপাত্ত নিয়ে গবেষণা কাজটি এগিয়ে নেয়া হয়েছে।

গবেষণা কাজে, প্রাপ্ত উপাত্তগুলোকে বর্ষা-পূর্ববর্তী (মার্চ-মে), বর্ষা (জুন-অগাস্ট), বর্ষা-পরবর্তী (সেপ্টেম্বর-নভেম্বর) এবং শীত (ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি) এই চারটি মৌসুমে ভাগ করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, গত ৩০ বছরে শীতকাল বাদে বাকি তিন মৌসুমেই নদীর প্রবাহ কমছে।

এছাড়াও নদীর প্রবাহ পরিবর্তনের আগের হিস্টোরিক্যাল ফ্লো বা ঐতিহাসিক প্রবাহ এবং প্রবাহ পরিবর্তনের পর রিসেন্ট ফ্লো বা সাম্প্রতিক প্রবাহ তুলনা করে পরিবর্তনটা খুবই বেশি হয়েছে বলে জানান গবেষক আলমগীর কবির।

একইসাথে জীববৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে পরিবর্তনের যে মাপকাঠি আছে, অর্থাৎ কতটুকু পরিবর্তন হলে তা সামাজিক বাস্তুতন্ত্রের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে তা পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখা গেছে, ‘কোনো নদীই নিরাপদ অবস্থায় নেই। সবগুলোই অনিরাপদ অবস্থায় আছে।’

নদীতে পানিপ্রবাহ কমে যাচ্ছে কেন?

বাংলাদেশের বেশিভাগ নদী আন্তঃসীমান্ত হওয়ায় ৮০ শতাংশ নদীর পানি অন্য পাড় থেকে আসে। ফলে ভারত বা চীনে অর্থাৎ উজানে সেতু, বাঁধ অন্য কোনো কাঠামো নির্মাণ করা হলে পানি প্রবাহে ব্যাঘাত ঘটে। এছাড়াও বাংলাদেশের ভেতরে খাল ও পুকুর ভরাট করার ফলে নদীর সাথে সংযোগ নষ্ট হচ্ছে। আবার নদীর পাশেও নানা ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের ফলে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। ফলে স্থানীয় এবং আন্তঃসীমান্ত নানা কারণ নদীর পানি কমে যাওয়ার জন্য দায়ী।

অধ্যাপক সারওয়ার হোসেন বলেন, ‘পানি নিরাপত্তার সাথে এসডিজি, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও অন্যান্য সমস্যা সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। এ সকল সমস্যা আলাদাভাবে সমাধান না করে সমন্বিতভাবে সোশ্যাল ইকোলজিক্যাল সিস্টেম এপ্রোচ প্রয়োগ করা জরুরি। সমন্বিত সমাধানের উপায় না বের করলে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা সামলে নেয়ার সক্ষমতা বাড়ার সম্ভাবনা নেই।’

আরেক গবেষক আলমগীর কবির বলেন, ‘প্রতিটা নদী অনিরাপদ আছে। বিশেষ করে পদ্মার ক্ষেত্রে দ্বি-পক্ষীয় চুক্তিতে বলা আছে, বাৎসরিক এবং মৌসুম অনুযায়ী কতটুকু পানি পাব। ফলে আন্তঃসীমান্ত চুক্তি থাকার পরও আমরা উজান থেকে পানি পাচ্ছি না।’

নদীর ন্যূনতম পানি কমে গেলে কী হয়?

নদীতে ন্যূনতম পানি না থাকার কারণে মাছের প্রজননস্থল ব্যাপকভাবে কমে গেছে। আবার নদীকেন্দ্রিক কৃষি নির্ভরতায় আগে চাষাবাদের জন্য পানির মূল উৎস ছিল নদী। কিন্তু দিন দিন পানি কমে আসায় নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে ধান ও চালের ব্যাপক ফলন হলেও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কৃষকরা স্বনির্ভর হতে পারছে না। আর এই উৎপাদন খরচ বাড়ছে নদীর পানির প্রবাহ আর আর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে। একইসাথে বাড়ছে ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের পানির লবণাক্ততা।

মো: সারওয়ার হোসেন বলেন, ‘উজান থেকে আসা মিঠা পানি আর সাগরের লবণাক্ত পানির সংমিশ্রণে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট একটি ইউনিক ইকোসিস্টেম।’ কিন্তু উজান থেকে মিঠা পানি না এলে, সাগরের পানির কারণে ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের লবণাক্ততা বেড়ে যাবে। ফলে ভারসাম্য থাকবে না। ফলে ‘পানির স্বল্পতা একটা নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তাছাড়া হিমালয় থেকে আসা পানির সাথে প্রচুর পলিও এসে জমা হয়। আর এই পলি দিয়েই বাংলাদেশ ডেল্টা বা ব-দ্বীপ তৈরি। উজান থেকে আসা পানির প্রবাহের সাথে এই পলিও ভাটির অংশের বিভিন্ন নদীতে ছড়িয়ে পড়ে নির্দিষ্ট মাত্রায় বঙ্গোপসাগরে চলে যাওয়ার কথা, অর্থাৎ পলির সমবণ্টন হওয়ার কথা। কিন্তু নদীর পানি কমে যাওয়ায় পলি জমতে জমতে নদীর ধারণক্ষমতা কমিয়ে দেয়। আর এর ফলে বর্ষা বা বর্ষা-পরবর্তী সময়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত বা বাঁধ খুলে দেয়ার কারণে অল্প পানিতে বন্যা দেখা দিতে পারে।

মো: সারওয়ার হোসেন বলেন, ‘পদ্মার মাইটি রিভারের (প্রমত্ত নদী) বৈশিষ্ট্য এখন আর নেই। পানি নিরাপদ সীমায় না থাকার এটা বাস্তব প্রভাব।’ এছাড়াও গঙ্গার নিচের অংশ আর পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীতে মাছের প্রজাতির বৈচিত্র্য কমে গেছে। একইসাথে গঙ্গার উজানে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ইলিশসহ অন্যান্য প্রজাতির মাছ।

এদিকে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে পরিবেশগত দিক থেকে হালদা নদীর অবস্থা সঙ্কটাপন্ন। প্রাকৃতিকভাবে বাংলাদেশের একমাত্র কার্প জাতীয় মাছের প্রজননক্ষেত্র হালদা হলেও নদীটিতে মাছের আবাস (বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে) ও প্রজনন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আলমগীর কবির বলেন, ‘সোশিও-ইকোলজিক্যাল সিস্টেম নষ্ট হলে পরিবেশগত, আর্থিক সামাজিক সব ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব দেখা যাবে। শুধু আমরাই না, ধীরে ধীরে উজানের মানুষও ক্ষতির শিকার হবে।’

সূত্র : বিবিসি

বাংলাদেশ জার্নাল/ওএফ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত