শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
ন্যাশনাল মেডিকেল ও সোহ্রাওয়ার্দী কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১৭:৫৬ আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২১:৩৬
ভুল চিকিৎসায় রাজধানীর ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর অভিযোগের ঘটনার বিচার চেয়ে রোববার দুপুর একটার পর পুরান ঢাকার ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। বেলা ২টার পর একদল শিক্ষার্থী কলেজের ভেতর ঢুকে ভাঙচুর চালিয়েছেন বলে ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকসহ হাসপাতালটির কর্মচারীরা বলেন। একইসঙ্গে ভাঙচুর করা হয়েছে কলেজের একটি অ্যাম্বুলেন্সও।
এদিকে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারামারির ঘটনাকে কেন্দ্র করে শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কলেজেও আজ ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, বেলা ২টার পর এ কলেজের ভেতরে ঢুকে শ্রেণিকক্ষসহ বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। দুপুরে এ ঘটনার পর সোহরাওয়ার্দী কলেজে চলমান অনার্স প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।
ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মাহাবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিতের মৃত্যুর ঘটনায় রোববার ঘেরাও কর্মসূচি দেয়া হয়েছিল। পূর্বঘোষিত সেই 'সুপার সানডে' কর্মসূচির অংশ হিসেবে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজসহ প্রায় দশটি কলেজের শিক্ষার্থীরা এদিন দুপুরে ন্যাশনাল মেডিকেলের সামনে অবস্থান নেয়।
আব্দুর রউফ কলেজ, বিজ্ঞান কলেজ, নটরডেম, সিদ্ধেশ্বরী, ডিএমআরসি, ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ, খিলগাঁও মডেল কলেজ, তেজগাঁও কলেজ, যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল কলেজসহ রাজধানীর বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা ন্যশনাল মেডিকেল কলেজ ঘেরাওয়ে অংশ নেন।
এক পর্যায়ে তারা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের প্রধান ফটক ভাঙচুর করেন। পরে বেলা সোয়া ১টার দিকে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের গেট ভেঙে ভিতরে প্রবেশ করে ভাঙচুর শুরু করে।
সে সময় সেখানে কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা অনার্স প্রথম বর্ষের ইতিহাস পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। গণ্ডগোলের মধ্যে নিরাপত্তার কারণে মাঝপথে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সোহরাওয়ার্দী কলেজে ঢুকে পড়লে পরীক্ষার্থী ও শিক্ষার্থীরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এসময় কলেজের উপাধ্যক্ষের কক্ষসহ অধিকাংশ কক্ষে ভাঙচুর চালায় বিভিন্ন কলেজ থেকে আসা আন্দোলনকারীরা।
কলেজ প্রাঙ্গণে থাকা একটি প্রাইভেট কার, মাইক্রেবাস, অ্যাম্বুলেন্স ও মোটরসাইকেল এ সময় ভাঙচুর করা হয়। এসময় কলেজের ট্রফি, চেয়ারসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে যেতে দেখা যায় হামলাকারীদের।
পরে শিক্ষক ও কর্মচারীদের অনুরোধে শিক্ষার্থীরা কলেজ প্রাঙ্গণ ছেড়ে দেন। কলেজে থাকা পরীক্ষার্থীরাও তখন ধীরে ধীরে বেরিয়ে যান।
মাহবুবুর রহামান মোল্লা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান মিনহাজ গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের সহপাঠী অভিজিৎ হত্যার বিচারের দাবিতে আমরা গতকাল এখানে এলে সোহরাওয়ার্দী কলেজের সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর হামলা চালায়। আমাদের ন্যায্য দাবিতে তারা কেন হামলা চালাল আজ জানতে এসেছিলাম। তারা আগ বাড়িয়ে আমাদের ওপর আক্রমণ করেছে। আমরা নিজেদের শুধু সেইভ করার চেষ্টা করেছি।
সোহরাওয়ার্দী কলেজের বাংলা বিভাগের ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী পরিচয় দেয়া মো. নাহিদ হাসান বলেন, ‘মোল্লা কলেজের সন্ত্রাসীরা আমাদের কলেজের ঢুকে ইচ্ছেমত হামলা চালিয়েছে। তাদের হাতে রড, রামদা ও দেশীয় অস্ত্র ছিল। আমাদের শিক্ষকদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে, ছাত্রীদের লাঞ্ছিত করেছে। ওরা বলাবলি করতেছিল আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে ওরা আবার হামলা করবে, আগুন দেবে। কলেজ শিক্ষার্থীরা এত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কীভাবে চালায়?’
সোহরাওয়ার্দী কলেজের উপাধ্যক্ষ ড. ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ওই কলেজের প্রিন্সিপাল ও আমাদের প্রিন্সিপাল একটা সমঝোতায় এসেছিলেন। আমরা আশ্বস্ত ছিলাম যে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু হবে না। কিন্তু তা হল না।
সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ ড. কাকলী মুখোপাধ্যায় গণমাধ্যমকে বলেন, গতকাল রাত পর্যন্ত মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলেছি। তারা বলল শিক্ষকদের সাথে কথা বলেছে, অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেছে। তারা বলল কোনো সমস্যা হবে না। সোয়া ১টার দিকে কিছু বোঝার আগেই সিসিটিভিতে দেখি প্রচুর ছেলেমেয়ে এসেছে। গেট ভেঙে ঢুকেছে। ইচ্ছামত ভাঙচুর করেছে। গাড়ি ভাঙচুর করেছে। গ্যাস লাইন ছেড়ে দিছে। আজ আমাদের কলেজে পরীক্ষা ছিল। ওরা মার্কশিট, খাতা, ল্যাপটপ সব কিছু নিয়ে চলে গেছে। আমি ঢাবিতে জানিয়েছি। প্রোভিসি বলেছিলেন অ্যাপ্লিকেশন পাঠাতে। ভাঙচুরের জন্য তাও পাঠাতে পারিনি। এরা কি ছাত্র হতে পারে? এত নাশকতা তো কোনো ছাত্র করতে পারে না।
কবি নজরুল কলেজের অধ্যক্ষ মোহম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, আসলে এটা আমাদের কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতরের ঘটনা না। আমাদের পরীক্ষা চলছে। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা গেটগুলো বন্ধ রেখেছি। আমি আর কিছু এখনই বলতে চাচ্ছি না।
কোতোয়ালি থানার পুলিশ পরিদর্শক নাসির উদ্দিন বলেন, সম্প্রতি ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের এক শিক্ষার্থী ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। পরে এ কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা আজ দুপুর একটার দিকে ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালের সামনে অবস্থান নেন। এতে পুরান ঢাকার জনসন রোডে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা জানান, তাদের কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী অভিজিৎ হাওলাদার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ওই হাসপাতালে ভর্তি হয়। ‘ভুল চিকিৎসায়’ অভিজিৎ মারা যায় বলে জানান তারা। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের দাবিতে গত বৃহস্পতিবার তারা মেডিকেল কলেজটির সামনে বিক্ষোভ করেন। তারা দাবি করেন, ওই দিন পুরান ঢাকার কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের ওপর হামলা চালান। এর প্রতিবাদে আজ তারা ন্যাশনাল মেডিকেলের সামনে বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় আবার পুরান ঢাকার সরকারি শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কলেজসহ আশপাশের কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের ওপর হামলা চালায়।
দুই পক্ষের শিক্ষার্থীদের মারামারিতে আহত কয়েকজনকে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থী অভিজিৎ হাওলাদারের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিকেলেও ন্যাশনাল মেডিকেলের সামনে বিক্ষোভ করেন ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা।
ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক রশিদুল হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, অভিজিতের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাদের হাসপাতালে ব্যাপক ভাঙচুর চালিয়েছেন একদল শিক্ষার্থী। এতে হাসপাতালের স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। রোগীদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
এদিকে, শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কলেজেও ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, বেলা ২টার পর এ কলেজের ভেতরে ঢুকে শ্রেণিকক্ষসহ বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। মো. রিশান নামে শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কলেজের এক শিক্ষার্থী বলেন, ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের কোনো শিক্ষার্থীকে তারা মারধর করেননি। অথচ ওই কলেজসহ অন্য কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের কলেজে এসে ভাঙচুর চালিয়েছেন।
শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ কাকলী মুখোপাধ্যায় আরও বলেন, আকস্মিক কয়েকশ শিক্ষার্থী এসে কলেজের ১৭টি বিভাগে হামলা চালিয়েছে। তারা বিভাগগুলোর অফিসকক্ষ থেকে কম্পিউটার লুটপাট ও ভাঙচুর করে। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত ৭ কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা চলছিল। হামলাকারী শিক্ষার্থীরা ওইসব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। এই কলেজে একটি মাইক্রোবাস, একটি প্রাইভেট কার ও দুটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়েছে।
বাংলাদেশ জার্নাল/এমপি