ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ আপডেট : ৩ মিনিট আগে
শিরোনাম

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

‘আব্বুরে গুল্লি কইররা মাইররা ফালাইসে, কেউ আমাগরে আর আদর করে না’

  প্রতিনিধি

প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৩:০৬  
আপডেট :
 ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৩:১০

‘আব্বুরে গুল্লি কইররা মাইররা ফালাইসে, কেউ আমাগরে আর আদর করে না’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজধানীর গুলিস্তানে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছেন মো. মনির। ছবি: সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজধানীর গুলিস্তানে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছেন মো. মনির। তিনি ভোলা জেলার তজুমদ্দিন উপজেলার শম্ভুপুর ইউনিয়নের খাসেরহাট বাজারের উত্তর দিকে মধ্য শম্ভুপুর গ্রামের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের দফাদার বাড়ির বাসিন্দা বৃদ্ধ আব্দুল মন্নান ও শাজেদা বেগম দম্পতির বড় ছেলে মো. মনির (৩৪)।

২০১৪ সালের দিকে প্রতিবেশী রোজিনা আক্তারের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় মনিরের। তাদের ১০ বছরের সংসারে এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তান আছে। স্ত্রী-সন্তানদের গ্রামে রেখে ঢাকাতেই জুটের ব্যবসা করতেন মনির।

এদিকে সরেজমিনে শহীদ মনিরের বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, বাবার সংসারে অভাবের তাড়নায় ১০ বছর বয়সে স্বপ্নের শহর ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন মনির। দীর্ঘদিন ঢাকায় দিনমজুরের কাজ করেছেন তিনি। এরপর জড়ান জুটের কাজে। পরে ঢাকার গুলিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় নিজেই জুট কেনা-বেচা করা শুরু করেন। তাতে লাভের মুখ দেখতে শুরু করলে দূর হতে থাকে তাদের পরিবারের দুর্দিন। ভালোভাবেই চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু অস্ত্রের একটা গুলি তার পরিবারে ফের অন্ধকারের সাগরে নিমজ্জিত করে।

মনিরের স্ত্রী রোজিনা আক্তার গণমাধ্যমকে বলেন, শেখ হাসিনা সরকার পতন হলে আমার স্বামী মনিরও সবার সঙ্গে আনন্দ মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। মিছিল চলাকালে ছাত্র জনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। সেখানে আমার স্বামী মনিরের শরীরে গুলি লাগে। গুলিটা তার পেট ছিদ্র করে বেরিয়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলে তিনি গুরুতর আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে ছাত্ররা তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করান।

তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওইদিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে আমার স্বামী মনিরের নাম্বার থেকে আমার কাছে ফোন আসে। মোবাইলের অপর প্রান্ত থেকে অচেনা এক লোক আমাকে বলেন ‘তিনি (মনির) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন’। পরে খবর পেয়ে আমার শ্বশুর ও আত্মীয়-স্বজন ঢাকায় গিয়ে মনিরের মরদেহটি দাফনের জন্য গ্রামের বাড়িতে আনেন। পরের দিন ৬ আগস্ট বিকেলে পারিবারিক কবরস্থানে মনিরকে দাফন করা হয়। মনিরের মৃত্যুর পর জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনসহ জেলা প্রশাসন, জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি নেতা মেজর হাফিজের পক্ষ থেকে কিছু সহায়তা পেয়েছি।

রোজিনা আক্তার বলেন, আমার স্বামী হত্যার বিচারসহ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের দুই সন্তানের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা চাই।

শহীদ মো. মনিরের আদরের ছেলে আবির (৯) ও মেয়ে জুনহা (৫) বাবা হারানোর যন্ত্রণার কথা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাগো আব্বু আর আইবো না, গুল্লি কইররা মাইররা ফালাইসে। আব্বুর মতো আর কেউ আমাগরে আদর করে না। আব্বুর কবর আমাগো বাড়ির সামনেই। কতক্ষণ পর পর আমরা দুই ভাই-বোন মিলে আব্বুর কবর দেখতে যাই।’

মনিরের বাবা আব্দুল মন্নান বলেন, শহিদ মনির আমার বড় পোলা। সে সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল। তার উপার্জনের টাকায় আমাদের সংসার চলতো। কিন্তু আমার উপার্জনক্ষম পোলাডারে গুল্লি কইররা মাইররা ফালাইসে। একদিকে আমার সংসার, অন্যদিকে মনিরের দুই সন্তানের ভবিষ্যতের নিরাপত্তার চিন্তা। এই দুইয়ে মিলে এখন আমি দিশেহারা। আমার পোলা হত্যার বিচার চাই। লগে মনিরের দুই সন্তানের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা চাই।

ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শুভ দেবনাথ বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের মধ্যে তজুমদ্দিনের মনির একজন। সরকারিভাবে তার পরিবারকে আর্থিক সহায়তার জন্য সব কাগজপত্র পাঠিয়েছি। সরকারি বরাদ্দ এলে আমরা তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করবো।

এ ঘটনায় গত ৪ নভেম্বর স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে শহীদ মনিরের স্ত্রী রোজিনা আক্তার বাদী হয়ে ঢাকার সি.এম.এম.আদালতে একটি হত্যা মামলা করেন। এটির সি আর মামলা নম্বর ১৬৫৯। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে শেখ রেহানা, ওবায়দুল কাদের, শেখ ফজলে নুর তাপস, ফেরদৌস আহমেদ, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক ডিবি প্রধান হারুন উর রশিদ, ভোলা-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নুরনবী চৌধুরী শাওন, ভোলা-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবসহ পুলিশ, র‍্যাব, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের ২২৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এছাড়া আরও ৩০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।

বাংলাদেশ জার্নাল/আরএইচ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত