ব্যবসায় গতি না ফিরলে বাড়বে খেলাপি ঋণ: ব্যবসায়ীদের সতর্কতা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:২৮
অন্তর্বর্তী সরকারকে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও জনগণের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় স্বস্তি (মূল্যস্ফীতি ও অন্যান্য)—এই চারটি বড় জায়গায় জোর দিতে হবে। এর মধ্যে সরকার অবশ্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য নিয়ে সচেষ্ট রয়েছে। অন্য তিনটি জায়গা উন্নতি করতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি দরকার।
সোমাবর (১১ নভেম্বর) ‘তৃতীয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলন ২০২৪: বৈষম্য, আর্থিক অপরাধ ও বাংলাদেশের অর্থনীতির নিরাময়’ শিরোনামে আয়োজিত এক সম্মেলনে বক্তারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর একটি হোটেলে এই সম্মেলনের আয়োজন করে দৈনিক বণিক বার্তা।
সেখানে বিদেশি বিনিয়োগের খরার বিষয়টি তুলে ধরা হলে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন বললেন, আগে নিজেদের বিনিয়োগ করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা রাখার অনুরোধ করে তিনি বলেন, আমার অফিসে আপনাদের সবাইকে স্বাগত। আমি আপনাদের ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট। আমার ব্যবসা নাই। আমি ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছি। “আই এশিউর ইউ টু বি ইয়োর সারভেন্ট ইন গিভিং ইউ হোয়াট ইউ নিড।”
ইউনিলিভার বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ফরেন ইনভেস্টর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মোহাম্মদ জাভেদ আখতার বলেন, “ভিয়েতনাম গত ৮ মাসে ১৪ বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে। বাংলাদেশে গত ৬ মাসে মাত্র ১ বিলিয়ন ডলার এসেছে।
“যারা বিনিয়োগ নিয়ে আসবে তাদের দেশের প্রতি আস্থা আসতে হবে। এই জায়গা তৈরি না করতে পারলে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব হবে না।”
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, “দেশে বেসরকারি খাতে সংকুচিত মুদ্রানীতি নেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারি খাতে খরচের সময় সম্প্রসারিত নীতি চলেছে। এ বৈষম্যের কারণে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ সংকুচিত মুদ্রানীতি বেসরকারি খাতকে গলা টিপে ধরছে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে বিনিয়োগ করতে চান। তারা দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য এক ধরনের স্থিতিশীল পরিবেশ আশা করেন।”
২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, “দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি, বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সহজ করার জন্য দ্রব্যমূল্যের দিকে নজর দিতে হবে।”
পোশাক শিল্পের পাশাপাশি কৃষিকে আগামীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচনা নিয়ে ব্যাক টু ব্যাক এলসি ও বন্ডেড ওয়ারহাউজ সুবিধা দেয়ার কথা পরামর্শ দেন তিনি।
অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার তেমন কার্যকরী পদক্ষেপ নিচ্ছে না। সরকারের কার্যক্রম শুধু ঢাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মাঠে তাদের কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না। বর্তমানে দেশে বড় কোনো বিনিয়োগ দেখা যাচ্ছে না। ফলে অস্থিরতা বিরাজ করছে।”
বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, “দেখুন আমি আমার বাড়িতে না খেলে তো মেহমান খাবে না। ইট ইজ ভেরি ভেরি সিম্পল। আমাদের আগে নিজেদের বিনিয়োগ করতে হবে। আমাদেরকে আস্থায় রাখুন। আমি আপনাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে, ব্যবসা সহজ করতে আমি আসার সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে চেষ্টা করব।”
সুদহার বেড়ে যাওয়া নিয়ে যে কথা হচ্ছে, সে বিষয়ে তিনি লেন, “এটা ৬-৯ পলিসির কু প্রভাব। “সোনারগাঁও হোটেলে মনিটারি পলিসি করা হয়েছে। এগুলোর কি ‘পাপমুক্তি’ করতে হবে না আমাদের? করতেই হবে। নয়ত এটা আরও ফ্রি ফল (পতন) করতেই থাকবে।”
ব্যবসার গতি না বাড়লে আরও বাড়বে খেলাপি ঋণ
ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধানে অন্তর্বর্তী সরকার সঠিক পথে আগালেও ব্যবসায় ধীর গতির কথা উল্লেখ করেন ব্যাংকাররাও।
সিটি ব্যাংকের এমডি এস এম মাশরুর আরেফিন বলেন, “ব্যাংকের লুটপাট শেষ। এখন ব্যাংকের অবস্থা আর খারাপ হবে না।”
দুর্বলদের নিয়ে একটা ব্যাংক করা যেতে পারে বলে মত দিয়ে তিনি বলেন, “এর মধ্যে কয়েকটা বড় ব্যাংক আছে। আগে ভালো ছিল, পরে খারাপ হয়েছে। এদের খেলাপি ঋণ পুরো খাতের ওপর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন ব্যবসায় গতি আনতে সরকারকে নজর দিতে হবে। ব্যবসা ধীর হলে খেলাপি ঋণ আরও বাড়বে।”
ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, “গত ১৫ বছর আমাদের ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম, অরাজকতা, দুর্নীতির জোয়ার চলেছে। গত কয়েক বছরে সেটা সুনামির আকার ধারণ করেছে। তবে এই সুনামি প্রতিরোধ করা গেছে। আস্তে আস্তে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। গত ৩ মাসে সামষ্টিক অর্থনীতি সঠিক নীতি নেওয়া হয়েছে।”
তিনি বলেন, “আমাদের এক্সচেঞ্জ রেট ৮৫ তে রাখা হয়েছিল বহু বছর। ফলে হঠাৎ করেই ইন্টারেস্ট রেট বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন তারা ব্যবসা করতে পারছেন না। তাদের বলব ধৈর্য ধরতে। শ্রীলঙ্কা পেরেছে আমরাও পারব।”
ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী বলেন, “জ্বালানির সরবরাহ ও উৎপাদনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। জ্বালানিতে অনেক সংস্কার প্রয়োজন। তবে দ্রুত সংস্কারের মধ্যে রিফাইনারি সংস্কার করা দরকার। ইস্টার্ন রিফাইনারি সব ধরনের ক্রুড প্রসেস করা যায় না। এ রিফাইনারি সংস্কারের গত ১৫ বছরে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি।”
একটি আধুনিক রিফাইনারি করা উচিত মত দিয়ে তিনি বলেন, “জ্বালানি দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। জ্বালানির সরবরাহ ও উৎপাদনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব না দিলে শিল্প, অর্থনৈতিক, ব্যবসা খাত সব খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই জ্বালানির নিরাপদ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।”
বাংলাদেশ জার্নাল/ওএফ