জীবনসঙ্গী খুঁজে নেয়ার ঐতিহ্যবাহী বউমেলা
দিনাজপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১:১৯
দিনাজপুরের বীরগঞ্জে হয়ে গেল একদিনের ব্যতিক্রমী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বউ মেলা বা মিলন মেলা। যে মেলায় তরুণ-তরুণীরা তাদের জীবনসঙ্গী খুঁজে পায়। আদিবাসী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে মনের আদান-প্রদান হয়ে গেলে অথবা একে অপরকে পছন্দ হয়ে গেলেই পারিবারিকভাবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ধর্মীয় রীতিনীতি মেনেই অভিভাবকদের উপস্থিতিতে হয়ে যায় বিয়ে।
প্রতিবছর শারদীয় দুর্গাপূজার বিজয়া দশমীর দ্বিতীয় দিন প্রচার-প্রচারণা ছাড়াই প্রতি বছর বাসিয়া হাটি নামে পরিচিত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মিলন মেলা বসে। মেলার প্রধান আকর্ষণ সাঁওতাল আদিবাসীদের জীবনসঙ্গী খুঁজে নেয়া। যার কারণে ঐতিহ্যবাহী বউমেলা নামে পরিচিত প্রায় ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে। সন্ধ্যার পূর্বে তরুণ-তরুণীরা তাদের জীবনসঙ্গী খুঁজে বের করে অভিভাবকদেরকে জানায়। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের পঞ্জিকা দেখে দিনক্ষণ ঠিক করা হয়, এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে দুই পরিবারের উপস্থিতিতে আত্মীয়-স্বজনকে সাক্ষী রেখেই বিয়ে সুসম্পন্ন করা হয়।
এই মেলা উপলক্ষে পুলিশ, আনসার, গ্রাম পুলিশ সমন্বয়ে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা জোরদার করে উপজেলা প্রশাসন ও জেলা প্রশাসন। তাই নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার থাকার কারণে কোনরকম অপ্রীতিকর ঘটনা এবছর ঘটেনি। শান্তিপূর্ণভাবে মেলাটি শেষ হয়েছে বলে দাবি করছেন আয়োজক কমিটি।
দিনাজপুরের বীরগঞ্জের গোলাপগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে বিজয়া দশমীর দ্বিতীয় দিন গোলাপগঞ্জ হাট হওয়ার কারণে একদিন পরে মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) অনুষ্ঠিত হয়। যুগ যুগ ধরে চলে আসা ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার (সাঁওতাল) ঐতিহ্যবাহী মিলনমেলা বা বউমেলা। বিকেলে শুরু হয় আলোচনাসভা ও সাঁওতাল আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সদস্য, জাতীয়তাবাদী দলের বীরগঞ্জ উপজেলা সভাপতি আলহাজ্ব মনজুরুল ইসলাম (মঞ্জু)। পৌর বিএনপির সভাপতি আমিরুল বাহার বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
বীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফজলে এলাহী বলেন, এক সময়ে এই মেলাটি আদিবাসীদের বউমেলা হিসেবে পরিচিত। এখন গোলাপগঞ্জের আশপাশসহ বিভিন্ন জেলা থেকেও দর্শনার্থীরা এই মেলায় আসেন। আদিবাসীদের নিজস্ব সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নাচ গান পরিবেশন করেন। পাশাপাশি আদিবাসী তরুণ তরুণীদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদানসহ পাত্র-পাত্রী দেখাদেখির সুযোগ থাকে। পরবর্তীতে বিয়ে হয়।
বীরগঞ্জ ‘আদবিাসী সমাজ উন্নয়ন সমিতির’ আয়োজনে এই মেলায় প্রচলতি প্রথা অনুযায়ী হাজার হাজার মানুষরে মধ্যে সাঁওতাল তরুণ-তরুণীরা তাদের জীবন সঙ্গী খুঁজতে আসে এই মেলায়। ১৮ পেরিয়ে ২৫ ছুঁই ছুঁই বয়সের তরুণ-তরুণীরা রকমারি সাজে বাড়ির বড়দের সঙ্গে মেলায় আসে জীবন সঙ্গীর নজর কাড়তে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আদিবাসীরা দলে দলে আসা শুরু করে বিদ্যালয়ের মাঠে, ভিড় বাড়তে থাকলেও মূল মেলা শুরু হয় বিকেল ৩টার পর হতে রাত পর্যন্ত। এই মেলায় হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটে।
মেলায় গিয়ে দেখা যায়, তিল ধারণের জায়গা নেই। কেউ বলেন, ১০০ বছরের বেশি। আর কেউ বলেন, ‘অনেক দিন ধরে’ এই মেলা চলছে। মেলাটি কবে থেকে শুরু হয়েছে কেউ বলতে পারে না। হবু কনে আর বরের জন্য মেলায় অংশ নিতে আসা সাঁওতাল তরুণ-তরুণীরা এক বছর ধরে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকেন।
ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনায় উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত ব্যতিক্রমধর্মী এই মেলা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সব বয়সী নারী-পুরুষের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। বাহারি সব কাঁচের চুরি, রঙিন ফিতা, লিপস্টিক, কানের দুল, ঝিনুকের মালা, মাটির তৈরি খেলনা, গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত দা, কুড়াল, হাড়ি, পাতিলসহ বিভিন্ন খাবারের দোকান নিয়ে দূর-দুরান্ত হতে আসা দোকানিরা ব্যস্ত ছিল তাদের দোকানের মালামাল বিক্রয় করা নিয়ে। চলতে থাকে বাজনার তালে তালে ঐতিহ্যবাহী নাচ ও গানের আসর। স্কুলমাঠের একদিকে চলে কনে বাছাই পর্ব।
সাঁওতাল তরুণীরা নিজেকে মেলে ধরেছেন রঙিন পোশাকে। নজর কাড়তে বাহারি ফুলের সাজে সাজেন। তাদের দৃষ্টি রুমাল বাঁধা হাতের দিকে। সঙ্গীদের দৃষ্টি কাড়তে হাতে রুমাল বেঁধে মেলায় এসেছেন সাঁওতাল তরুণরা। সন্ধ্যা গড়ানোর আগেই বেঁধে ফেলতে হবে সঙ্গী। তারপর শুরু হবে এক জোড়া জীবনের স্বপ্নময় পথচলার পর্ব। মেলায় আসা বেশির ভাগ ছেলেমেয়ের বয়স আঠারো পেরিয়ে পঁচিশের ঘর ছুঁই ছুঁই। রকমারি সাজের তরুণ-তরুণীর ভিড় বাড়তে বাড়তে হাজার ছাড়িয়ে যায়। ভালো লাগা প্রিয় মুখটি কার নজরে পড়বে, বলা ভার।
দিনাজপুর সেতাবগঞ্জ থেকে আসা রুবেল মুরমু বলেন, আমি ২৫ পেরিয়েছি। গত বছরে এসেছিলাম, এ বছরও এসেছি। এখন পর্যন্ত পাত্রীর সন্ধান পাইনি। দেখা যাক সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করছি যদি পাওয়া যায়।
রোজিনা হাঁসদা বলেন, আমি নবম শ্রেণিতে পড়ছি। আমি এখন বিয়ে করব না। তারপরও ইচ্ছা আছে, একজন সরকারি চাকরিজীবী ছেলেকে বিয়ে করতে চাই। তারপরও পরিবার থেকে সম্মতি থাকতে হবে। তবেই আমি বিয়ে করবো।
নিজপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান আনিস বলেন, আগে কঠিন সামাজিক বিধিবিধান থাকলেও বর্তমানে অনেকেই রাষ্ট্রীয় নিয়মনীতি মেনে বিয়ে করছেন। তরুণ-তরুণীরা একে অপরকে পছন্দ করলে পারিবারিক আলোচনার মধ্য দিয়ে বিয়ের মাধ্যমে তারা তাদের দাম্পত্য জীবন শুরু করেন। একসময় পাত্রী পছন্দ হলে পাত্র তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে যেতেন নিজের বাড়িতে। এখন সে প্রথা না থাকলেও, বর-কনে পছন্দের জন্য মেলায় ভিড় জমান সাঁওতাল তরুণ-তরুণীরা। সঙ্গে অভিভাবকরাও থাকেন। বাদ্য-বাজনার তালে চলে বউ বাছাইয়ের উৎসব। তবে সময়ের হাত ধরে এই প্রক্রিয়াতেও এসেছে পরিবর্তন। এখন পছন্দ হলেই বিয়ে হয়ে যায় না। বরং পছন্দ হলে তা অভিভাবকদের জানানো হয়। অভিভাবকরা একমত হলেই তবে শুরু হয় বিয়ের কাজ।
গোলাপগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মহেন চন্দ্র রায় বলেন, ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন বয়সের মানুষের পাশাপাশি মেলায় হিন্দু ও মুসলিমসহ বিভিন্ন ধর্ম ও বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে মেলা হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত।
বীরগঞ্জ ‘আদিবাসী সমাজ উন্নয়ন সমিতি’র সভাপতি শীতল মার্ডী জানান, এক সময় এই মেলার নাম ছিল বউ মেলা। এখন এ মেলা ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠীর মিলন মেলা নামে পরিচিত। পূর্বপুরুষরা এই মেলা শুরু করেন। আমরা তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে যাচ্ছি। তবে কবে থেকে এ মেলার প্রচলন শুরু হয়েছে সেটা সঠিকভাবে বলা যাবে না। বাপ-দাদার কাছে শুনেছি যুগ যুগ ধরে এ মেলা আপনা আপনি চলছে। আমরা শুধু আনুষ্ঠানিকতা চালিয়ে যাচ্ছি তাদের পথ ধরে। এই মেলাকে কেন্দ্র করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সম্প্রদায়ের আত্মীয়-স্বজনরা বছরে একবার হলেও এই এলাকায় মিলিত হয়।
বাংলাদেশ জার্নাল/এমপি