অর্থের অভাবে চিকিৎসা হচ্ছে না চোখে গুলিবিদ্ধ আশরাফুলের
সুলতান মাহমুদ চৌধুরী, দিনাজপুর
প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ২১:৩২
আশরাফুল ইসলাম (৩৪)। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ডান চোখে গুলি লাগে। ডান চোখ একেবারেই দৃষ্টিশক্তি নেই, অন্ধ হয়ে গিয়াছে। আরেকটি চোখ ভালো রয়েছে তবে ধীরে ধীরে বাম চোখেরও দৃষ্টি শক্তি কমে আসছে। সব সময় কালো চশমা পরে থাকতে হচ্ছে। একটু কথা বললেই মাথায় ব্যথা শুরু হয়ে যায়।
দিনাজপুর পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের উত্তর শেখপুরা মহল্লার আক্কাস আলীর ছেলে বাস শ্রমিক আশরাফুল ইসলাম। গত ৪ আগস্ট দিনাজপুর শহরের সদর জেনারেল হাসপাতালের সামনের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয় আশরাফুল ইসলাম। এখন নিজ বাসায় অসহায় অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন তিনি।
আশরাফুল ইসলাম পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি হওয়ায় পরিবারটি এখন মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। আশরাফুল ইসলামের স্ত্রী শামীমা বেগম, মেয়ে জান্নাতুন (৪) ও ছেলে সিয়াম বাবু (৩) নিয়ে তার পরিবার। বাবা আক্কাস আলী ও মা রাশেদা বেগম রয়েছে।
গত ৪ আগস্ট দিনাজপুরের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে মিছিলের সামনে থাকায় ছররা গুলি ডান চোখে এসে লাগে। এছাড়া ২০ থেকে ২২টি গুলি শরীরের বিভিন্ন স্থানে লাগে।
চিকিৎসক বলেছেন, ডান চোখে গুলি এখনও রয়েছে পাঁচ বার অপারেশন করা হয়েছে। তারপরও চোখ থেকে গুলি বের করা সম্ভব হয়নি। তাই ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি একেবারেই নেই। বাম চোখের দৃষ্টি অনেকটা কমে আসতে শুরু করেছে। চিকিৎসা গ্রহণ করতে ইতিমধ্যেই কয়েক লক্ষাধিকা টাকা ঋণ হয়েছে।
আশরাফুলের স্ত্রী শামিমা বেগম বলেন, কয়েকটি এনজিও থেকে ঋণ করেছি। নিকট আত্মীয়দের কাছ থেকেও ধারদেনা করে স্বামীকে চিকিৎসা করাতে পারলেও এখন আর চিকিৎসা করাতে পারছি না। এনজিওর সমিতির কিস্তি দিতে পারছি না। অসুস্থ স্বামী আর ছেলে-মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ঘুম আসে না। এখন শ্বশুর-শাশুড়ি জীবিত আছেন। শ্বশুর দিনমজুর, শাশুড়ি মানুষের বাড়িতে ঝি এর কাজ করেন। তাদের উপার্জনের অংশ দিয়ে কোন রকম খেয়ে-পরে আছি। তবে স্বামীর জন্য ওষুধ ক্রয় করতে পারছি না। স্বামী আশরাফুলের উন্নত চিকিৎসা করাতে পারলে হয়তো একটি চোখ রক্ষা করা যাবে। অপর চোখটি তো একেবারেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে বলে চিকিৎসক জানিয়ে দিয়েছেন।
পরিবারের সঙ্গে আশরাফুল ইসলাম
আশরাফুল ইসলামের মা রাশেদা বেগম বলেন, আমার এই সন্তানকে নিয়ে একাই যুদ্ধ করে আসছি। গত চার আগস্ট দিনাজপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আমার ছেলে আশরাফুল ইসলাম বাড়ি থেকে বের হয়। সে পেশায় ছিল একজন বাস শ্রমিক। দুপুর একটার দিকে জানতে পারি আমার ছেলে আশরাফুল গুলিবিদ্ধ হয়েছে। দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতালে দৌড়ে দেখি আমার ছেলে নেই। এরপর জানতে পারলাম দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখি একটা স্যালাইন দিয়ে মেঝেতে ছেলে পড়ে আছে। চোখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। আমার ছেলে চিৎকার করছে। চিকিৎসক সেদিন ছিল না। অনেকক্ষণ পর একজন চিকিৎসক দেখা পেলেও তিনি আন্দোলনের গুলিবিদ্ধ আন্দোলনকারীদের চিকিৎসা করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তার একদিন পর দিনাজপুর চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। সেখানেও চক্ষু হাসপাতালের প্রধান ফটক ছিল তালাবদ্ধ। পরে একজন চিকিৎসকের বাড়িতে গিয়ে তার হাত-পা ধরে আমার ছেলের গুলি বের করার চেষ্টা করলেও তিনি চোখের গুলি বের করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তার পরামর্শে ছেলেকে বাঁচাতে হলে ঢাকায় চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে যান। ১৭ হাজার টাকা মাইক্রোবাস ভাড়া করে ঢাকায় মালিবাগে চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানেও টাকার জন্য চিকিৎসা করাতে পারিনি। একপর্যায়ে পরিচালককে অনুরোধ করে ছেলের চোখের গুলি বের করার চেষ্টা করলেও তারাও গুলি বের করতে পারেনি। একে একে পাঁচবার চোখের অপারেশন করা হয়। কিন্তু এখনো তার চোখের গুলি রয়েছে গিয়েছে। এখন বাড়িতে নিয়ে এসেছি। কিন্তু টাকার অভাবে এখন আর চিকিৎসা করাতে পারছি না। এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোন রকমের আর্থিক সহযোগিতাও পাইনি। আমার ছেলের দৃষ্টিশক্তি দিন দিন কমে যাচ্ছে। তার ছোট দুটি বাচ্চা রয়েছে। তাদের ভবিষ্যৎ কি হবে। ছেলের চিকিৎসাই বা করাবো কি দিয়ে। এমন চিন্তা থেকে রাতে ঘুম আসে না। বুক ফেটে যায়, চিৎকার করে কাউকে বলতে পারছিনা।
আশরাফুল ইসলাম বলেন, ৪ আগস্ট হঠাৎ করেই বুঝে উঠার আগেই ছড়রা গুলি আমার দিকে চলে আসে। হঠাৎ করে দেখি চোখ দিয়ে ঝাপসা দেখছি। এরপর চোখ দুটি বন্ধ হয়ে জ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় পড়ে যাই। এরপর কে বা কারা আমাকে তুলে নিয়ে হাসপাতালে যায়। এরপর আর কিছু বলতে পারি না। এর দুইদিন পর জ্ঞান ফিরে পেয়ে চোখের যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকি। একপর্যায়ে আমাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর পাঁচটি অপারেশন করা হয়। আমার চোখে কিন্তু এখন পর্যন্ত চোখের মনির মাঝখান দিয়ে একটি গুলি ঢুকে চোখের শেষ প্রান্তে গিয়ে আটকে আছে বলে চিকিৎসক আমাকে জানিয়েছেন। তবে ডান চোখ দিয়ে কিছু দেখতে পাই না। সব সময় পানি পড়ছে। আর বাম চোখ দিয়েও দিনের আলো ঝাপসা দেখতে পাই। ওষুধ তো ঠিকমতো কিনতে পারছি না। কারণ আমি নিজে পেশায় একজন বাস শ্রমিক। এখন কাজ করতে পারছি না। তাই আয়-রোজগার হচ্ছে না। ওষুধ কিনার অর্থ নেই। তাই চিকিৎসা করাতে পারছি না। ছোট ছোট দুটি বাচ্চার দিকে তাকালে কান্নায় ভেঙে পড়ি। ছোট দুই বাচ্চাকে খাবার কিনে দেয়ার সামর্থটুকু হারিয়ে ফেলেছি। নিজেকে এখন এত অসহায় লাগছে আর ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। হয়তোবা সেদিন একটা গুলি বুকে লাগলেও যদি পৃথিবী থেকে চলে যেতে পারতাম। হয়তোবা এই যন্ত্রণা আর ভোগ করতে হত না। কিন্তু ছোট ছোট শিশুদের দিকে তাকিয়ে বাঁচতে বড় ইচ্ছা করে। তবে একটা কথা বারবার মনে পড়ছে এই স্বৈরাচারী সরকারকে হঠাতে পেরেছি। একটু মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে চেয়েছিলাম। এই স্বৈরাচার সরকার পালিয়েছে কিন্তু তার দোসররা এখনো রয়ে গিয়েছে। তাদের হাত থেকেও এখনো আমরা রক্ষা হতে পারিনি। কারণ যেখানেই যাচ্ছি সেখানেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আমরা যারা আহত হয়েছি, চিকিৎসা সেবা তো দূরের কথা তাদের কাছ থেকে ভালো ব্যবহারটুকু এখনো পাচ্ছি না। তাই প্রধান উপদেষ্টাসহ এই সরকারকে বলবো বৈষম্য যেন আর সমাজে না থাকে। আমার একটি চোখ হারিয়েছে, প্রয়োজনে আরেক চোখ দিয়ে হলেও দেশে সুশাসন যেন প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশ জার্নাল/এমপি