ঢাকা, শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩০ ভাদ্র ১৪৩১ আপডেট : কিছুক্ষণ আগে
শিরোনাম

ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদন

নির্বাচন ঘিরে ফেসবুকে আওয়ামী লীগের পক্ষে মন্তব্য করেছিল ‘বট’

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ২৯ আগস্ট ২০২৪, ১৭:৪৮  
আপডেট :
 ২৯ আগস্ট ২০২৪, ১৮:০৫

নির্বাচন ঘিরে ফেসবুকে আওয়ামী লীগের পক্ষে মন্তব্য করেছিল ‘বট’
গবেষণায় ভুয়া বলে শনাক্ত ৮টি ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একই প্রোফাইল ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলের ফেসবুক পেজে নানান মন্তব্য করা হয়েছে ভুয়া (ফেক) ফেসবুক প্রোফাইল থেকে। এসব ফেসবুক প্রোফাইল পরিচালিত হয়েছে বট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। এমন ১ হাজার ৩৬৯টি ফেসবুক প্রোফাইলের একটি বট নেটওয়ার্কের সন্ধান পেয়েছে ডিসমিসল্যাবের গবেষকরা।

বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) গবেষণা প্রতিবেদনটি ডিসমিসল্যাবের ওয়েবসাইটে প্রকাশ হয়েছে। ‘ডিসমিসল্যাব’ হলো তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইটের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ।

বট নেটওয়ার্ক মূলত একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা, যেখানে বিশেষ সফটওয়্যারের (বট) মাধ্যমে কাজ করা হয়। বট নেটওয়ার্কের কার্যক্রম আংশিকভাবে কম্পিউটারভিত্তিক বা স্বয়ংক্রিয়। তারা একটি তালিকা থেকে নির্দিষ্ট ‘কি-ওয়ার্ড’ বা শব্দ ধরে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পোস্ট বাছাই করে। আরেকটি তালিকা থেকে বেছে নিয়ে মন্তব্য পোস্ট করে। এই প্রক্রিয়ায় কোথায় কী মন্তব্য পোস্ট করা হচ্ছে, সেখানে মানুষের নজরদারি নেই বললেই চলে।

ডিসমিসল্যাবের গবেষণায় দেখা গেছে, বট নেটওয়ার্কের ফেসবুক প্রোফাইলগুলো থেকে আওয়ামী লীগের পক্ষে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও বিরোধীদলের ফেসবুক পেজের ১৯৭টি পোস্টে সমন্বিতভাবে ২১ হাজারের বেশি মন্তব্য করা হয়েছে। বিভিন্ন পোস্টে একই মন্তব্য করা হয়েছে। একই মন্তব্য বিভিন্ন প্রোফাইল থেকে পোস্ট করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

গবেষণায় দেখা যায়, বট নেটওয়ার্কটি সক্রিয় হয় গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক আগে আগে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বট নেটওয়ার্কটি ঘুরেফিরে ৪৭৪টি একই ধরনের রাজনৈতিক মন্তব্য করেছে। এসব মন্তব্য নির্বাচনের আগে তৈরি করা হলেও বট নেটওয়ার্কটি নির্বাচনের পরেও মন্তব্যগুলো পোস্ট করে গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২১ জুন ‘কালার প্রিন্টারে ছাপানো প্রতিটি পৃষ্ঠায় থাকে অদৃশ্য কোড? ‘’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের অনলাইন গণমাধ্যম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ও এর ফেসবুক পেজে। উভয় ক্ষেত্রে পোস্টের নিচে একটি মন্তব্য ছিল- ‘এবারের নির্বাচন স্বচ্ছ হবে। আগামী নির্বাচনে জনগণ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে। আর এবার ভোট চুরি করতে পারবে না বলেই বিএনপি নির্বাচনে আসতে ভয় পাচ্ছে আর এত কাহিনি করছে।’

নির্বাচনের প্রায় ছয় মাস পরে এসেও ‘ব্যবহারকারীরা’ এই পোস্টের নিচে বিএনপির সমালোচনা, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সফল ও সুষ্ঠুভাবে হওয়ার আশাবাদ, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের দাবিসহ নানান রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে একের পর এক মন্তব্য করে।

এমন মন্তব্যের কারণ খুঁজতে গিয়ে ১ হাজার ৩৬৯টি ফেসবুক অ্যাকাউন্টের একটি বট নেটওয়ার্কের সন্ধান পায় ডিসমিসল্যাব। নেটওয়ার্কটি মাত্র ছয় মাসে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও বিরোধী দলের ফেসবুক পেজের ১৯৭টি পোস্টে সমন্বিতভাবে ২১ হাজারের বেশি মন্তব্য করেছে।

গবেষণায় দেখা যায়, বট নেটওয়ার্কটি সাধারণত রাজনৈতিক পোস্টেই মন্তব্য করে। ফেসবুক পোস্টে নির্দিষ্ট কিছু রাজনৈতিক ‘কি-ওয়ার্ড’ বা শব্দ পেলে তারা সেই পোস্টে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু কখনো কখনো তাদের ভুল হয়। যেমনটি হয়েছে ‘ইসি’ (নির্বাচন কমিশন) শব্দের ক্ষেত্রে। কালার প্রিন্টার-সংক্রান্ত খবরটির সারাংশে ‘মেশিন আইডেনটিফিকেশন কোড (এমআইসি) ’ এর উল্লেখ ছিল। সেখানে ‘ইসি’ শব্দাংশ দেখেই বট নেটওয়ার্কটি শ খানেক মন্তব্য করে।

ভুয়া প্রোফাইলের ছড়াছড়ি: ডিসমিসল্যাব ১ হাজার ৩৬৯টি প্রোফাইলের প্রাইভেসি সেটিংস, বন্ধুসংখ্যা, পোস্ট করার প্রবণতা, পরিচিতি তথ্য ও প্রোফাইল ছবি পর্যালোচনা করেছে। দেখা গেছে, বেশির ভাগের প্রোফাইল ‘লকড’ বা ‘প্রাইভেট’ করা। সেগুলো সক্রিয় হয়েছে নির্বাচনের আগে। প্রোফাইল ছবি নেই অথবা চুরি করা। তাদের বন্ধুসংখ্যা খুব কম বা নেই। বেশির ভাগ অ্যাকাউন্ট দুটি নির্দিষ্ট পেজকে ফলো করে। আর এই বৈশিষ্ট্যগুলো রাজনৈতিক বটের প্রচলিত সংজ্ঞার সঙ্গে মিলে যায়।

প্রোফাইলগুলোর মধ্যে ২৪৭টি ‘লকড’ অবস্থায় ছিল। বাকি ১ হাজার ১২২টি অ্যাকাউন্টের মধ্যে ৭০ শতাংশের ক্ষেত্রে প্রোফাইল ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করা অন্যদের ছবি ব্যবহার করেছে। আবার একই ছবি বিভিন্ন প্রোফাইলে ব্যবহার করা হয়েছে।

গবেষণার ১ হাজার ৩৬৯টি প্রোফাইলের ৭৭ শতাংশ নারীদের নামে। এই নামেও রয়েছে অদ্ভুত মিল। নারীদের প্রোফাইলের ২৪ শতাংশের নাম ‘আক্তার’ দিয়ে শেষ হয়েছে। যেমন- দিয়া আক্তার, রিয়া আক্তার, লিজা আক্তার, লিমা আক্তার, লিসা আক্তার ইত্যাদি।

পুরুষদের প্রোফাইলগুলোর একটি বড় অংশের শেষ নাম হিসেবে ব্যবহার হয়েছে ‘আহমেদ’। যেমন- নাঈম আহমেদ, নাদিম আহমেদ, কামিল আহমেদ, মাহিন আহমেদ, সামির আহমেদ ইত্যাদি।

নারী-পুরুষ উভয় ধরনের প্রোফাইলের ৯০ শতাংশ নামই দুই শব্দের। কিছু ক্ষেত্রে একটি নামকেই ভেঙে দুই শব্দ করা হয়েছে। যেমন- রি পা, মি না, লি জা, যু থি, লাম ইয়া, মু না, নে হা, জোস না ইত্যাদি।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন হয় গত ৭ জানুয়ারি। কিন্তু ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল, মে বা জুন মাসেও বট প্রোফাইলগুলো থেকে ‘আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন’, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে’ জাতীয় শব্দ ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ, মন্তব্যগুলো নির্বাচনের আগে তৈরি করা। কিন্তু তা নির্বাচনের পরেও নির্বিচারে পোস্ট করা হয়েছে।

এমনকি বট প্রোফাইল থেকে অপ্রাসঙ্গিক পোস্টেও রাজনৈতিক মন্তব্য করা হয়েছে। এসব পোস্টের প্রতিটির বিবরণেই কোনো না কোনোভাবে ‘ইসি’ শব্দটি আছে। যেমন- আইসিইউ, আইসিসি, রইসি, আইএফআইসি, ওআইসি, আইসিটি, ডায়ালাইসিস বা ক্রাইসিস। বট নেটওয়ার্কটি তার লক্ষ্যবস্তু পেজে যেখানেই ‘ইসি’ শব্দাংশ পেয়েছে, সেটি প্রাসঙ্গিক হোক আর না হোক, সেখানেই সমন্বিতভাবে রাজনৈতিক মন্তব্য করেছে।

বট নেটওয়ার্কটি কম্পিউটারভিত্তিক অপপ্রচারের একটি উদাহরণ বলে মন্তব্য করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের ফিলিপ মেরিল কলেজ অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইনফরমেশন স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক নাঈমুল হাসান। তিনি বলেন, ‘আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ ও কম্পিউটারভিত্তিক টুলের সাহায্যে সংঘবদ্ধভাবে মূলত এই কাজগুলো করা হচ্ছে।’

বাংলাদেশ জার্নাল/কেএইচ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত