ঢাকা, শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩০ ভাদ্র ১৪৩১ আপডেট : ৩ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

গাজী টায়ার্স কারখানায় লুটপাট করতে গিয়েই নিখোঁজ ১৭৫

  নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশ : ২৭ আগস্ট ২০২৪, ২১:২৬

গাজী টায়ার্স কারখানায় লুটপাট করতে গিয়েই নিখোঁজ ১৭৫
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজী টায়ার্সে অগ্নিকাণ্ড। ছবি: সংগৃহীত

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজী টায়ার্সে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কোনো শ্রমিক নিখোঁজ না থাকলেও অন্তত ১৭৫ জন নিখোঁজ আছেন বলে দাবি করেছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের স্বজনেরা। তবে কারখানা কর্তৃপক্ষ, পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী ও নিখোঁজ ব্যক্তির স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে- গাজী টায়ার্স কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের সময় লুটপাট করতে গিয়েই নিখোঁজ হয়েছেন ওই ১৭৫ জন।

মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনসহ অধিকাংশই বলেছেন, নিখোঁজ ব্যক্তিদের বেশির ভাগই কারখানায় লুটপাট করতে এসেছিলেন। আবার কেউ কেউ স্বজনদের খোঁজে বা ঘটনা দেখতে কারখানায় ঢুকেছিলেন।

দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, স্বজনেরা অনেকে নিখোঁজের বিষয় জানাচ্ছেন। নিখোঁজ ব্যক্তিদের একটি তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগুনের ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমানকে প্রধান করে আট সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে।

ঘটনার অন্তত ২০ জন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ছয়তলা ভবনে লুটপাটের সময় নিচতলায় আগুন দেয়া হয়। ভবনের ভেতর যারা ছিলেন, তারা লুটপাটের জন্য বা পরিস্থিতি দেখতে ভবনের ভেতরে ঢুকেছিলেন। আগুন দেওয়ার পৌনে তিন ঘণ্টা পর রাত পৌনে ১২টার দিকে ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিস যায়। তার আগে ভবনে আটকে পড়া লোকজনের কেউ কেউ ভবনের ছাদ থেকে তাদের বাঁচাতে চিৎকার করেন।

এ সময় কারখানার নিচে থাকা খাদুন এলাকার বাসিন্দা রতন খান পাইপ বেয়ে ছাদের ওপরে উঠে একটি রশি দেন। সেই রশি বেয়ে তখন অনেকেই নিচে নেমে আসেন। তিনি জানান, অগ্নিসংযোগের পর ওপরে অসংখ্য মানুষ আটকে পড়েছিলেন। রাত ১২টা নাগাদ তারা চিৎকার করছিলেন। একপর্যায়ে তিনি পাইপ বেয়ে ছাদে ওঠেন। রতনের দাবি, ভবনে যারা ছিলেন, তাদের অধিকাংশই লুটপাটের জন্য গিয়েছিলেন। কেউ কেউ আগুন লাগার পর ভবনের ভেতরে থাকা স্বজনদের নামিয়ে আনতে ওপরে ওঠেন।

দুই বছরের সন্তান কোলে নিয়ে কারখানার পোড়া ভবনের সামনে বসে কাঁদছিলেন পাশের মুড়াপাড়া এলাকার এক নারী। তিনি জানান, তার স্বামী রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। কারখানায় লুটপাট শুরুর খবর শুনে গত রোববার (২৫ আগস্ট) বিকেলে কারখানায় আসেন। রাত ৯টার সময় স্বামীর সঙ্গে মুঠোফোনে তার সর্বশেষ কথা হয়। তখন তিনি কারখানার ভেতরে ছিলেন। এরপর আর তার খোঁজ পাওয়া যায়নি।

কারখানায় আসার কারণ নিয়ে তিনি বলেন, লুটপাট করতে আইছিল। তার আগেও তো নিছে। তহন কোনো সমস্যা হয় নাই। ওই নারীর মতো নিখোঁজ ব্যক্তিদের অন্তত চারজন স্বজন লুটপাট করতে আসার বিষয়টি স্বীকার করেছেন।

তারা জানান, সরকার পতনের পর রূপগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানাধীন গাজী টায়ার্স ও গাজী পাইপ কারখানায় লুটপাটের পর আগুন দেয়া হয়। ৫ আগস্ট শুরু হওয়া লুটপাট শেষ হয় ৮ আগস্ট। এতে রূপগঞ্জের কয়েক হাজার মানুষ অংশ নেন। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এরপর রোববার (২৫ আগস্ট) গোলাম দস্তগীর গাজীর গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়লে দ্বিতীয় দফায় আবার বিভিন্ন গ্রামের লোকজন লুটপাটে জড়ান। অন্যদের দেখাদেখি নিখোঁজ ব্যক্তিরা লুটপাট করতে কারখানায় এসেছিলেন।

মইকুলী এলাকার এক জামদানি কারিগর ভাইয়ের খোঁজে কারখানায় এসেছেন। তিনি জানান, ৫ আগস্টের পর তার গ্রামের অনেকেই কারখানায় লুটপাট করেছেন। তার ২০ বছর বয়সী ভাইয়ের বন্ধুও লুটপাটকারীদের একজন। রোববার (২৫ আগস্ট) লুটপাটের খবর জানার পর সেই বন্ধুর সঙ্গে তার ভাই বিকেলে কারখানায় আসেন। তারপর থেকে দুজনের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

৩৮ বছর বয়সী এই জামদানি কারিগর বলেন, প্রথমবার লুটপাটের পর কোনো আইনগত পদক্ষেপ না নেয়ায় গ্রামের লোকজন বিষয়টিকে অপরাধ মনে করেননি। ৫ আগস্টের পর লুটপাটকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিলে রোববার (২৫ আগস্ট) কেউ লুটপাটের সাহস পেতেন না।

নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে গাজী টায়ার্সের কোনো শ্রমিক নেই বলে দাবি করে কারখানার সহকারী মহাব্যবস্থাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, ৫ থেকে ৮ আগস্ট কারখানায় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। তার পর থেকে কারখানার উৎপাদন বন্ধ। রোববার (২৫ আগস্ট) লুটপাট শুরুর সময় কারখানায় কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী ও কর্মকর্তা ছিলেন। মাইকে ঘোষণার পর লুটপাটকারী ব্যক্তিরা কারখানায় ঢুকতে শুরু করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তখন তারা কারখানার বাইরে চলে যান।

সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, লুটপাটের একপর্যায়ে লুটপাটকারী দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। রাত ৯টা নাগাদ কাঁচামালের গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত ছয়তলা ভবনে লুটপাট চলতে থাকে। এরই মধ্যে কে বা কারা ভবনের নিচতলায় আগুন দেয়। তখন লুটপাটকারী ব্যক্তিদের একটি অংশ ভবনে আটকে পড়ে বলে তারা শুনেছেন।

হামলার ঘটনার পর পুলিশের কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ করে সাইফুল ইসলাম বলেন, লুটপাট শুরুর পর থানাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন জায়গায় জানিয়েছি। পুলিশ আসেনি। পরে সেনাবাহিনীর একটি দল কারখানার ফটকের সামনে আসে। কিন্তু ১০ মিনিটের বেশি দাঁড়ায়নি। রাতে আগুন দেওয়ার পর ফায়ার সার্ভিস আসে। শুরুতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হলে এমন নিখোঁজের ঘটনা ঘটত না।

বাংলাদেশ জার্নাল/কেএইচ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত