ঢাকা, রোববার, ০৭ জুলাই ২০২৪, ২৩ আষাঢ় ১৪৩১ আপডেট : কিছুক্ষণ আগে
শিরোনাম

দুর্নীতি দমন কমিশনে এমপির আমলনামা

  নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ : ০৪ জুলাই ২০২৪, ১৫:৫১  
আপডেট :
 ০৪ জুলাই ২০২৪, ১৫:৫৭

দুর্নীতি দমন কমিশনে এমপির আমলনামা
আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম এমপি

ছিলেন সরকারের উপসচিব। সেখান থেকে এমপি। এরপর হাজার কোটি টাকার মালিক। নাম তাঁর আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার সার্ভিসে ১৯৮৬ সালে যোগ দেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের করা ঢাকার মতিঝিল থানায় মামলার পর ২০০৮ সালে উপসচিব থেকে পদত্যাগ করে অবসরে যান। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রভাব বিস্তার করে সেই মামলা থেকে খালাস পান। তবে ২৩ বছরের চাকরি জীবনে সর্বোচ্চ ১ কোটি টাকা বেতন পেলেও বর্তমানে এমপি নাসিম ও তার স্বজনরা হাজার কোটি টাকার মালিক। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় স্থানীয় নেতাকর্মীরা।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে হলফনামায় নাসিম ও তার স্ত্রী ডা. জাহানারা আরজু বর্তমানে ১০৮ কোটি ৩৭ লাখ ৪১ হাজার ৮৪৫ টাকার সম্পদ দেখিয়েছেন। বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন ৩ কোটি ৫৭ হাজার ২৯৫ টাকা এবং মেয়ে- স্ত্রীর ৬৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৫০ টাকা।

স্থানীয়দের মতে এমপি ও তার পরিবারের সদস্যদের দেশ-বিদেশে নামে-বেনামে রয়েছে হাজার কোটি টাকার অর্থ-সম্পদ। এ ছাড়াও কানাডায় রয়েছে বাড়ি-গাড়ি। মেয়ে রাকা চৌধুরী এখনও কানাডায় অবস্থান করছেন। এমপি হওয়ার আগেও তিনি পরিবার নিয়ে প্রায়ই কানাডায় থাকতেন। স্থানীয়দের প্রশ্ন-একজন সাবেক আমলা এত অর্থ- সম্পদ ও ব্যবসার মালিক হন কীভাবে? এসব অর্থ - সম্পদ অবৈধভাবে গড়ে তুলেছেন বলেও অভিযোগ তাদের অনেকের। অন্যদিকে প্রভাবশালী এই এমপির কারণে দলের অনেক প্রবীণ নেতাকর্মীও কোণঠাসা হয়ে রয়েছে। রয়েছে ফেনী আওয়ামী লীগেও চরম অসন্তোষ।

গত ২৭ জুন অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান ও তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) চেয়ারম্যান বরাবর অভিযোগ করেছেন ফেনীর ছাগলনাইয়ার আবদুল হাই নামে এক ব্যক্তি।

সম্প্রতি জমা পড়া অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, ফেনী-১ আসনের সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম তার স্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডা. জাহানারা আরজু নির্বাচনের হলফনামায় ১০৮ কোটি ৩৭ লাখ ৪১ হাজার ৮৪৫ টাকার সম্পদের মালিক হিসেবে স্বীকার করলেও বাস্তবে তারা হাজার কোটি টাকার মালিক। নামে-বেনামে তাদের রয়েছে শত শত বিঘা জমি। ঢাকায় রয়েছে অসংখ্য ফ্লাট ও বিলাসবহুল গাড়ি। একজন সরকারি কর্মকর্তা থেকে বনে গেছেন বিলিয়নিয়ার।

অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশন সন্দেহভাজনদের দুর্নীতির তালিকা প্রকাশের পরে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পদের চাকরি তিনি ছেড়ে দেন। তালিকা প্রকাশের পর সম্পদের হিসাব চেয়ে চিঠি দেয় দুদক। তারপর অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মতিঝিল থানায় মামলা করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার প্রভাব বিস্তার করে সেই মামলা থেকে অব্যাহতি নেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

অভিযোগে আরও বলা হয়, সরকারের বিভিন্ন দফতরে কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ২০ পার্সেন্ট কমিশন নিয়ে থাকেন। এ ছাড়াও ফেনী বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের মানুষের কৃষিজমি জিম্মি করে কাউকে দিয়েছেন স্বল্পমূল্য আবার কেউ জমি লিখে দিতে না চাইলে সেই জমি তিনি দখল করে নিয়েছেন।

আবদুল হাই নামে ওই ব্যক্তির অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সাবেক সদস্য ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমের বিরুদ্ধে রয়েছে পদ বাণিজ্যের অভিযোগ। চট্টগ্রাম বিভাগের যেখানেই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী অঙ্গসংগঠনের কমিটি করা হয়, সেখানেই তিনি হস্তক্ষেপ করেন। নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে পদে বসাতে শুরু করেন তার নানা অপপ্রচার। তাকে মাসোয়ারা না দিলে কাউকে তিনি শান্তিতে রাজনীতি করতে দেন না। নাসিমের শ্বশুর আবু তাহের চৌধুরীর বিরুদ্ধেও রয়েছে সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ।

নাসিমের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অনুসন্ধান করে তাকে আইনের আওতায় আনতে প্রধানমন্ত্রী ও দুদক চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপ কামনা করেন আবদুল হাই।

এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে মামলা করা হবে। দুদকের একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনে বিপুলসংখ্যক অভিযোগ জমা পড়ছে। সব অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে অনুসন্ধানের কাজ চলছে। ফেনী-১ আসনের এমপির বিরুদ্ধে করা অভিযোগটিরও যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, ফেনীর পরশুরামে ৩০ একর জায়গায় ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত করা হয় আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম কলেজ। স্থানীয়দের অভিযোগ, জোরপূর্বক ও ভয় দেখিয়ে নামমাত্র মূল্য পরিশোধ করে কলেজের জন্য কৃষিজমির জায়গা দখল করে নেওয়া হয়। এবার ফেনী-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য হয়ে মনোনয়ন বাণিজ্য করে ছাগলনাইয়া, ফুলগাজী ও পরশুরামে তার অনুসারীদের দিয়ে নানা কায়দাকৌশল করে নির্বাচনের মাধ্যমে উপজেলা চেয়ারম্যান বানান। এ ছাড়া নির্বাচনি এলাকার বাইরেও অন্যান্য উপজেলায়ও তার অনুসারীদের চেয়ারম্যান বানাতে ভূমিকা রাখার অভিযোগ রয়েছে।

নির্বাচনি হলফনামা : ফেনী-১ (পরশুরাম ফুলগাজী ও ছাগলনাইয়া) আসনে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আলাউদ্দিন নাসিমের হলফনামায় দেওয়া তথ্যানুযায়ী, আলাউদ্দিন নাসিমের বার্ষিক আয় ৩ কোটি ৫৭ হাজার ২৯৫ টাকা এবং তার স্ত্রীর ৬৯ লাখ ৪৬ হাজার ৬৫০ টাকা। আলাউদ্দিন নাসিমের বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট, দোকান বা অন্যান্য ভাড়া হিসেবে আয় ৯০ লাখ ৭৪ হাজার ৯২৫, স্ত্রীর ১৫ লাখ ৮৭ হাজার ৭৯৪ টাকা। ব্যবসা থেকে আয় করেন ১১ লাখ টাকা ২৫ হাজার টাকা, স্ত্রীর ৭ লাখ ৫৭ হাজার ২৭৯ টাকা। শেয়ার, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানত, ডিভিডেন্ডে রয়েছে ৯৫ লাখ ৯৭ হাজার ৩৭০ টাকা, স্ত্রীর ২৩ লাখ ২২ হাজার ৩০৪ টাকা। চাকরিতে তার ১ কোটি ২ লাখ ৬০ হাজার এবং স্ত্রীর ১৩ লাখ ৩ হাজার ৩৪৪ টাকা বার্ষিক আয় দেখিয়েছেন। এ ছাড়া স্ত্রীর পেশাখাতে ৯ লাখ ৭৫ হাজার ৯২৯ টাকা আয় দেখানো হয়েছে। হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, আলাউদ্দিন নাসিমের অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নগদ টাকা রয়েছে ১ কোটি ৩৩ লাখ ১৪ হাজার ৪৬৩ টাকা, স্ত্রীর ৪২ লাখ ৩৩ হাজার ৭২৫ টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাকৃত অর্থের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ৪ কোটি ১৪ লাখ ১৫ হাজার ১১৯ টাকা, স্ত্রীর ৯৩ লাখ ৪৭ হাজার ৯৯৮ টাকা, বন্ড, ঋণপত্র, স্টক এক্সচেঞ্জ তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয়। এমন কোম্পানির শেয়ার রয়েছে ৫২ কোটি ৬২ লাখ ৩৩ হাজার ৫৪৯ টাকার, স্ত্রীর ৩ কোটি ৫৭ লাখ ২৭ হাজার ২৬৮ টাকা।

পোস্টাল, সেভিংস সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র ও স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ রয়েছে ৫ কোটি ২০ লাখ ১৬ হাজার ৪৬২ টাকা, স্ত্রীর ১৫ লাখ টাকা। তার বাস-ট্রাক-মোটরগাড়ি ও মোটরসাইকেল যানের অর্জনকালীন মূল্য ২ কোটি ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকা, স্ত্রীর ৯০ লাখ ১৫ হাজার টাকা, স্বর্ণ ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু রয়েছে ২ লাখ টাকা, তার স্ত্রীর ২৪ লাখ ৬ হাজার টাকা। এ ছাড়া তাদের দুজনের ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী, আসবাবপত্র ও অন্যান্য সম্পদ রয়েছে ১৭ কোটি ৭৭ লাখ ১ হাজার ৭৩১ টাকা। হলফনামায় দেখা গেছে, নাসিম চৌধুরীর স্থাবর সম্পদের মধ্যে কৃষিজমি রয়েছে ১০ কোটি ১৩ লাখ ৪৫ হাজার ১৪৭ টাকা, তার স্ত্রীর ৪৬ লাখ ৪৬ হাজার ৭৯৬ টাকা, অকৃষি জমি ২৫ লাখ ৫২ হাজার টাকা, স্ত্রীর ৭৭ লাখ ৩২ হাজার টাকা।

এ ছাড়াও তার ৮ কোটি ৫২ লাখ ৯৩ হাজার ৪৬৬ টাকা মূল্যের তিনটি দালান (আবাসিক ও বাণিজ্যিক) রয়েছে। ১২ কোটি ৩১ লাখ ৪৬ হাজার ৯২০ টাকা মূল্যের ৬টি ও তার স্ত্রীর ২ কোটি ২৫ লাখ ৯৪ হাজার ২০১ টাকা মূল্যের ৪টি বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে।

তবে অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য জানতে বুধবার নাসিমের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

বাংলাদেশ জার্নাল/এসবিটি

  • সর্বশেষ
  • পঠিত