ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ আপডেট : ৬ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

মালয়েশিয়ায় প্রতারকের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব শেরপুরের ৩২ যুবক

  সুজন সেন, শেরপুর প্রতিনিধি

প্রকাশ : ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:৫০

মালয়েশিয়ায় প্রতারকের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব শেরপুরের ৩২ যুবক
প্রতারক আল আমিন। ছবি: প্রতিনিধি

উন্নত জীবনের আশায় মালয়েশিয়া গিয়ে প্রতারক দলের খপ্পরে পড়ে নিঃস্ব ও অমানবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন শেরপুরের ৩২জন যুবক। ইতোমধ্যে ওই বন্দিদশা থেকে পালিয়ে দেশে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছেন চারজন। এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চেয়ে ভুক্তভোগীদের মধ্যে একজন বাদী হয়ে প্রতারকদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন।

অন্যদিকে অভিযুক্তদের হামলায় আহত মামলার বাদী বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছেন। এদিকে এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

জানা যায়, পাচার হওয়া ওই ৩২জন যুবকের বাড়ি শেরপুর সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে। পালিয়ে দেশে ফিরে আসা ভুক্তভোগী যুবকরা হলেন- সাপমারি গ্রামের তৌহিদুল ইসলাম, জঙ্গলদী গ্রামের হাসু এবং কুঠারাকান্দা গ্রামের সাজিবুর রহমান ও সুজন মিয়া।

মামলার নথি সূত্রে জানা যায়, সদর উপজেলার ভাতশালা ইউনিয়নের কুঠুরাকান্দা গ্রামের সবজি বিক্রেতা আরশাদ আলীর ছেলে অভিযুক্ত প্রতারক আল-আমিন ও আরমান আলী বেশ কয়েক বছর আগে মালয়েশিয়ায় যায়। এর কিছু দিন পর দেশে ফিরে মালয়েশিয়ায় তারা কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করেছে বলে স্থানীয়দের জানায়। পাশাপাশি আল আমিন নিজেকে মালয়েশিয়ার ব্রেক্স ইনফিনিটি এসডিএন বিএইচডি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক বলে পরিচয় দেয়। সেই সাথে ওই প্রতিষ্ঠানের নামে ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে দিয়ে আস্থা অর্জন করে। পরে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে উচ্চ বেতনে কিছু লোক নিয়োগ করা হবে বলে এলাকায় প্রচার করে।

এক পর্যায়ে আশপাশের গ্রামের ৩২জন যুবক নিজেদের সহায় সম্বল বিক্রি করে ও বিভিন্ন এনজিও এবং দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে জনপ্রতি অন্তত পাঁচ লাখ টাকা তুলে দেয় প্রতারক আল-আমিন ও তার সহযোগীদের হাতে। পরবর্তীতে ২০২৩ সালের জুন-জুলাই মাসের মধ্যে ওই যুবকদের মালয়েশিয়ায় নিয়ে যায় আল আমিন। সেখানে পৌঁছার পর ভুক্তভোগীরা জানতে পারেন তাদের নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে মালয়েশিয়ায় নেয়া হয়েছে। এবং সেখানে তাদের মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে।

পরে বাধ্য হয়ে তারা নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে দুই মাস কাজ করে। এক পর্যায়ে ওই কাজ বন্ধ হয়ে যায়। বিষয়টি অভিযুক্ত আল-আমিনকে বলা হলে তিনি জানান, মালয়েশিয়ায় বর্তমানে কোন কাজ নেই। তাদেরকে কিছু দিন বসে থাকতে হবে। এ জন্য থাকা-খাওয়া বাবদ তাকে আরও এক লাখ টাকা দিতে হবে। এর প্রতিবাদ করায় প্রত্যেকের ওপর বর্বর নির্যাতন চালায় আল আমিন ও তার চক্রের সদস্যরা।

ভুক্তভোগী সাজিবুর রহমান বলেন, মালয়েশিয়ায় একটি ছোট রুমে আমাদেরকে অনাহারে-অর্ধাহারে আটকে রাখা হয়ে ছিল। সেখানে অন্যদের মাঝে শেরপুরের ৩২জনও ছিল। পরে আমরা চারজন সুযোগ বুঝে ওই বন্দিদশা থেকে পালিয়ে দেশে ফিরে আসতে সক্ষম হই।

সাজিবুর রহমান আরও বলেন, এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চেয়ে গত ২৮ মার্চ শেরপুর মানব পাচার ট্রাইব্যুনাল আদালতে পাচারকারী চক্রের হোতা আল আমিনসহ তার পরিবারের পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আল আমিনের সহযোগীরা পরদিন ২৯ মার্চ রাতে আমার ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে হত্যার চেষ্টা করে। ওই সময় হামলাকারিদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আমার শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষত-বিক্ষত হয়। পরে জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেই।

পরে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে গত ১৪ এপ্রিল বিকালে আমার মা-বাবা ছাড়াও অন্য ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যসহ শত শত গ্রামবাসী এক মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে।

ভুক্তভোগী যুবক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, বিদেশে গিয়ে দেখি আল আমিনের সেখানে কোন কোম্পানী নাই। সে মূলত দালাল। তার বাবা দেশে এক সময় কচুরমুখী বিক্রি করতো। গ্রামে এখন তার ডুপ্লেক্স বাড়ি আছে। ওই বাড়ির নিরাপত্তার জন্য লাগানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা।

মালয়েশিয়ায় বন্দিদশায় থাকা এক যুবকের স্বজন রহমত আলী বলেন, প্রতারকরা আমার ভাতিজাকে আটকে রেখে আরও টাকা দাবি করছে। টাকা দিতে না পারায় তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে চোখ-মুখ দিয়ে রক্ত বের করে দিয়েছে। ভিডিও কলের মাধ্যমে ওইসব অত্যাচার-নির্যাতনের ছবি আমাদেরকে দেখানো হয়েছে। এ বিষয়ে ভাতশালা ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের মেম্বার আব্দুল বারেক বলেন, বিদেশে যাওয়ার জন্য আমাদের গ্রামের অনেক যুবক আল আমিনের কাছে টাকা দিয়ে হতাশ। অনেক আগে তার মাধ্যমে যারা মালয়েশিয়া গিয়েছে তাদের অনেকেই কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এই আদম পাচারকারীর বিচারের দাবিতে এলাকাবাসী আজ একাট্টা।

এদিকে বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেতে সরকারের কাছে আকুল আবেদন জানিয়েছেন বাকি ভুক্তভোগীদের স্বজনরা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ব্রেক্স ইনফিনিটি এসডিএন বিএইচডি নামের প্রতিষ্ঠানটি মূলত একটি রিত্রুটিং এজেন্সি। যার পরিচালক বাপ্পী চৌধুরী। তিনি মালয়েশিয়ায় থাকেন। অভিযুক্ত আল আমিন তার এজেন্সির কেউ না বলে তিনি দাবি করেছেন।

অন্যদিকে ৩২জন যুবককে মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে প্রতারক আল আমিন বলেন, তাদের কাউকেই শারীরিক নির্যাতন করা হয়নি। মালয়েশিয়ায় বর্তমানে কাজ নেই। তাই সবাইকে একসঙ্গে রাখা হয়েছে এবং খাবারের ব্যবস্থাও করা হচ্ছে।

শেরপুর সদর থানার ওসি (তদন্ত) শফিকুল ইসলাম বলেন, মানব পাচারের বিষয়টি নিয়ে মামলার বিপরীতে বাদীর ওপর হামলার ঘটনায় অভিযোগ পেয়েছি। আমাদের তদন্ত চলমান আছে। জড়িতদের অচিরেই আইনের আওতায় আনা হবে।

বাংলাদেশ জার্নাল/ওএফ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত