ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ আপডেট : ২ মিনিট আগে
শিরোনাম

ভারত-বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা বিতর্ক

জাতিসংঘে পাল্টাপাল্টি চিঠি, মহীসোপান নিয়ে বিরোধ কাটবে?

  জার্নাল ডেস্ক

প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৬:২৮

জাতিসংঘে পাল্টাপাল্টি চিঠি, মহীসোপান নিয়ে বিরোধ কাটবে?
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। ফাইল ছবি

২০০৯ সালে মহীসোপান নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিতর্ক শুরু। সেবার ভারত তাদের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য যে বেইজ পয়েন্ট নির্ধারণ করেছিলো, তার দুটি নিয়ে আপত্তি ছিল বাংলাদেশের। এরপর গত ১৩ সেপ্টেম্বর সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারতের দাবির বিরোধিতা করে জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ।

২০১৪ সালে সমুদ্রসীমা নিয়ে আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতের রায়ে বাংলাদেশ নতুন প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা পেয়েছে। কিন্তু গত এপ্রিলে বাংলাদেশের দাবির ওপরে আপত্তি এবং নিজেদের কিছু দাবি দাওয়া জানিয়ে চিঠি দেয় ভারত। চিঠিতে বলা হয়- বাংলাদেশ যে মহীসোপান নিজেদের বলে দাবি করছে, তা ভারতের মহীসোপানের অংশ।

আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে ভারত বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হলেও মহীসোপানের দাবিকে ঘিরে এ বছর জাতিসংঘে দুই দেশের পাল্টাপাল্টি চিঠি এবং বেইজলাইন নিয়ে আপত্তি নতুন এক বিরোধ সামনে এনেছে।

মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা বিরোধ মিটে যাওয়ায় বাংলাদেশের উপকূল থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত টেরিটরিয়াল এবং ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল সুনির্দিষ্ট হয়। তবে ২০০ নটিক্যাল মাইলের পর মহীসোপানের বাংলাদেশের দাবিতে ভারতের আপত্তি নতুন এ বিরোধের জন্ম দিয়েছে।

বঙ্গোপসাগরে ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তি হয় আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে। ২০১১ সালে ইটলসের রায়ে মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়।

নতুন সংকট

সমুদ্রসীমানা নিয়ে দুটি রায়ের পর বাংলাদেশ যখন নতুন বেইজলাইন টেনে মহীসোপানের দাবি উপস্থাপন করে, তারপরই বর্তমান সংকটের শুরু।

বাংলাদেশ জাতিসংঘে মহীসোপানের দাবি প্রথম তুলে ধরে ২০১১ সালে। কিন্তু মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির পর মহীসোপানের ওই দাবি সংশোধন করে ২০২০ সালে নতুন করে কমিশনে জমা দেয়।

বাংলাদেশ সংশোধিত মহীসোপানের দাবি উপস্থাপনের ছয় মাসের মধ্যেই ভারত জাতিসংঘে চিঠি দিয়ে আপত্তি জানায়। ২০২১ সালের ১৬ এপ্রিল ভারত জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিক চিঠিটি দিয়ে বাংলাদেশের মহীসোপানের দাবির ব্যাপারে আপত্তি তুলে ধরে।

সম্প্রতি বাংলাদেশও জাতিসংঘে পাল্টা চিঠি লিখে দেশের অবস্থান স্পষ্ট করেছে।

জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সাবেক কর্মকর্তা বিজন কুমার সাহা ভারতের মহীসোপান এলাকার জরিপ নিয়ে দীর্ঘসময় কাজ করেছেন। সবশেষ সিনিয়র ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বিজন কুমার সাহা বলেছেন, মহীসোপানের দাবির প্রশ্নে ভারতের আপত্তি কোথায়।

তিনি বলেন, উইদিন দ্য ইইজেড, দ্যাট মিনস দ্য বাউন্ডারি, সেখানে বাংলাদেশ অ্যাডভানটেজ (সুবিধা) পেয়েছে। আমি অ্যাডভানটেজ কথাটাই ব্যবহার করছি।

তিনি আরও বলেন, কিন্তু লিগ্যাল কন্টিনেন্টাল শেলফ্ যেটা বাংলাদেশ দাবি করেছে, সেটাতে ভারত সরকারের বক্তব্য হচ্ছে এটা গ্রে এরিয়ার (ধুসর এলাকা) ভেতরে পড়ে যাচ্ছে এবং ইন্ডিয়ার যে এক্সক্লুসিভ ইকনোমিক জোন তার ভেতরে পড়ে যাচ্ছে। তার মানে ২০০ নটিক্যাল মাইলের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে।

বেইজলাইন (ভিত্তিরেখা) বিতর্ক

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে মহীসোপানের দাবি নিয়ে বর্তমান বিরোধের মূলে রয়েছে দুই দেশের বেইজলাইন। এ বেইজলাইন নিয়ে দুই দেশেরই পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং আপত্তি আছে।

এ বেইজলাইন বা ভিত্তিরেখা ধরেই উপকূল থেকে সমূদ্রের ১২ নটিক্যাল মাইল টেরিটরিয়াল সী, দুইশত নটিক্যাল মাইল বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং তারপর মহীসোপান পর্যন্ত পরিমাপ করা হয়।

দুই দেশের বেইজলাইন সমুদ্র উপকূল জুড়ে বিভিন্ন অবস্থানে পয়েন্ট আকারে নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংশোধিত বেইজলাইনে পাঁচটি পয়েন্ট আছে আর ভারতের বেইজলাইনের ৮৯টি পয়েন্ট দ্বারা বিভক্ত।

ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সীমানা নির্ধারণের পর বাংলাদেশ ২০১৫ সালে বেইজলাইন সংশোধন করে। সেই বেইজলাইনের ভিত্তিতে ২০২০ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘের কমিশনে মহীসোপানের দাবি উপস্থাপন করে। বাংলাদেশের নতুন বেইজলাইনের ২ ও ৫ নম্বর পয়েন্টের অবস্থান নিয়ে ভারতের আপত্তি।

বাংলাদেশের নতুন বেইজলাইনের ২ ও ৫ নম্বর পয়েন্টে ব্যাপারে ২০১৭ সালের ৩ আগস্ট ভারত জাতিসংঘের কাছে একটি চিঠি লিখে সুনির্দিষ্ট করে আপত্তি জানায়।

ওই চিঠিতে বলা হয়, নতুন বেইজলাইন ধরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা টানলে বাংলাদেশের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল ভারতের অংশে ঢুকে পড়ে, যেখানে একটি গ্রে এরিয়া বা ধুসর এলাকা চিহ্নিত রয়েছে।

২০১৪ সালে সমুদ্রসীমা নিয়ে আদালতের রায়ের পর বাংলাদেশ নতুন করে বেইজলাইন সংশোধন করে। সেই বেইজলাইন ধরে জাতিসংঘে মহীসোপানের দাবি সংশোধিত আকারে পেশ করে ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে।

বাংলাদেশের বক্তব্য হলো আদালতের রায় এবং আন্তর্জাতিক আইন ও বিধি মেনেই বাংলাদেশ বেইজলাইন নির্ধারণ করেছে।

বাংলাদেশ অভিযোগ করছে যে, ভারত আদালতের রায়ের পর তাদের বেইজলাইন সংশোধন করেনি। ভারত বেইজলাইন সংশোধন না করায় গ্রে এরিয়ার সমস্যা রয়ে গেছে। বিশেষ করে ভারতের বেইজলাইনের ৮৭ ও ৮৯ নম্বর পয়েন্ট নিয়ে আপত্তি রয়েছে বাংলাদেশের।

বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে শুরু থেকেই কাজ করছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম বিষয়াবলি ইউনিটের সচিব অবসরপ্রাপ্ত রিয়ার এ্যাডমিরাল মো. খুরশেদ আলম। তিনি বলেন, আদালতের রায় অনুসরণ করে আইন-কানুন মেনেই বাংলাদেশ তাদের বেইজলাইন সংশোধন করেছে এবং মহীসোপানের সংশোধিত দাবি জাতিসংঘে উপস্থাপন করেছে।

তিনি আরও বলেন, ভারতের বেইজলাইন যেটা বালাশোর উপকূল থেকে সোজা যে টানা হয়েছে, সেখানে ৮৭ নম্বর পয়েন্ট দশ কিলোমিটার সমুদ্রের ভেতর রয়েছে- যে কারণে গ্রে এরিয়া সৃষ্টি হয়।

খুরশেদ আলম আরও জানান, এটা না থাকলেতো গ্রে এরিয়ারই সৃষ্টি হয় না এবং পয়েন্ট ৮৯ এটা এখনো বাংলাদেশের সমূদ্রসীমার ২.৩ নটিক্যাল মাইল ভেতরে। ২০০৯ সাল থেকে এটা তারা এখনো সরিয়ে নেইনি। আমরা এটাই বলেছি যে, তোমরা আপত্তি দিয়েছো, তার আগে তোমাদের কাজগুলো ঠিক করা দরকার ছিল।

সমাধান কীভাবে

বাংলাদেশ জাতিসংঘে মহীসোপানের যে দাবি দিয়েছে, সেটির আয়তন আট হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার। আর বিতর্কিত ‘গ্রে এরিয়া’ বা ধূসর এলাকার আয়তন ৭২০ বর্গকিলোমিটার। কিন্তু বাংলাদেশের দাবি, ভারত আদালতের রায় মেনে তাদের বেইজলাইন সংশোধন করলে এই ‘গ্রে এরিয়া’ থাকে না।

অবসরপ্রাপ্ত রিয়ার এ্যাডমিরাল মো. খুরশেদ আলম জানান, মহীসোপানের বিষয়টি এখন জাতিসংঘের কমিশনই নিষ্পত্তি করবে। তবে কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনাও অব্যাহত আছে।

তিনি আরও জানান, কূটনৈতিকভাবে কথাবার্তা চলতেছে। আবার ওনারা চিঠি দিচ্ছে আমরাও দিচ্ছি। দেখা যাক এটা কূটনৈতিকভাবে যদি সমাধান হয়, ওনারা পয়েন্ট দুটো উঠিয়ে নেয় ফাইন। কিন্তু মহীসোপানের ব্যাপারে হয়তো কূটনৈতিকভাবে কিছু করার নাই, এটা জাতিসংঘ করবে।

মহীসোপানের দাবি নিষ্পত্তি নিয়ে ভারতের সাবেক জরিপ কর্মকর্তা বিজন কুমার সাহা বলেন, আপত্তি যে যাই করুক মহীসোপানের সিদ্ধান্ত হবে বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে। এটা কেউ চাইলেই পাবে- বিষয়টা এমন নয়।

তিনি আরও জানান, দুটো দেশের বাউন্ডারি সেটা স্থল বা জলসীমায় হোক, সেটা একটা ম্যাটার অফ ডিমারকেশন। কিন্তু এক্সক্লুসিভ ইকনোমিক জোন বা লিগ্যাল কন্টিনেন্টাল শেলফ এটা লজ অফ দা সী’তে পরিস্কারভাবে বলে দেয়া আছে যে, ২০০ নটিক্যাল মাইলের পরে কতটুকু মহীসোপান পাওয়া যাবে, কি কি কারণে পাওয়া যাবে, কি করলে পাওয়া যাবে, কোথায় পাওয়া যাবে। নিশ্চয়ই কমিশন এসব বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই সিদ্ধান্ত দেবেন।

সাগরের মহীসোপান এলাকায় পানিতে মাছ ধরার অধিকার থাকে সব দেশের। কিন্তু মহীসোপানের মূল গুরুত্ব হলো মাটির নিচের সম্পদের কারণে। মহীসোপান যে দেশের অধিকারে থাকবে, সে দেশই ওই এলাকার মাটির নিচের সম্পদের মালিক হবে। মহীসোপানে তেল গ্যাস অনুসন্ধান এবং অন্য যেকোনো খনিজ পদার্থ উত্তোলন অনুসন্ধানের জন্য এর বিরোধ নিষ্পত্তির প্রয়োজন। সূত্র- বিবিসি বাংলা

বাংলাদেশ জার্নাল/ওয়াইএ

  • সর্বশেষ
  • পঠিত