ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১ আপডেট : ২ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

মোদির সফর

কঠোর নিরাপত্তায় প্রস্তুত গোপালগঞ্জ

  গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশ : ২৫ মার্চ ২০২১, ১৫:৫৬  
আপডেট :
 ২৫ মার্চ ২০২১, ১৬:২৩

কঠোর নিরাপত্তায় প্রস্তুত গোপালগঞ্জ
ওড়াকান্দি ঠাকুরবাড়ি

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধি ও কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দি গ্রামের তীর্থস্থান ঠাকুরবাড়ি যাচ্ছেন ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২৭ মার্চ) তারা গোপালগঞ্জ যাবেন। এ উপলক্ষ্যে ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধুর সমাধি ও ঠাকুরবাড়িতে শেষ হয়েছে সকল প্রস্তুতি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির আসার খবরে খুশি টুঙ্গিপাড়াবাসীসহ মতুয়া ভক্তরা। তাদের আগামনে জেলায় নেয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা।

জানা গেছে, ২৭ মার্চ সফরকালে মোদি টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপশি বৃক্ষরোপণ করবেন। মোদিকে স্বাগত জানাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও টুঙ্গিপাড়ায় যাবেন বলে জানা গেছে।

বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে নরেন্দ্র মোদি ওড়াকান্দির ঠাকুরবাড়ি পরিদর্শন করবেন। এ সময় তিনি শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের মন্দিরে পূজা-আর্চনা করে ঠাকুরবাড়ির সদস্য ও অন্য একটি মাঠে মতুয়া নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন।

তাদের আগমনে বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স ও ঠাকুরবাড়ির বিভিন্ন মন্দির সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধনের পাশাপশি শেষ হয়েছে সকল প্রস্তুতি। সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স চত্বরসহ পুরো এলাকা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে কাজ করে যাচ্ছে তারা।

নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে পুরো এলাকা

এদিকে ঠাকুরবাড়ির আশপাশের পুরো এলাকা বাঁশ দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। মোদিসহ কর্মকর্তাদের বহন করা হেলিকপ্টার নামতে ঠাকুরবাড়ির পাশে তৈরি করা হয়েছে ৪টি হেলিপ্যাড। হেলিপ্যাড থেকে ঠাকুরবাড়ি যাওয়ার সড়কসহ লিংক রোড ও ঢাকা-খুলনা থেকে ঠাকুরবাড়ি যাওয়া-আসার সড়ক সংস্কার করা হয়েছে। মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে পুরো ঠাকুরবাড়িজুড়ে নেয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির পাশাপাশি নিবিড় পর্যবেক্ষণের জন্য বিভিন্ন স্থানে লাগানো হয়েছে ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা।

শেখ হাসিনা ও মোদির এ সফরে মতুয়া ভক্তসহ টুঙ্গিপাড়াবাসীর মধ্যে দেখা দিয়েছে বেশ আনন্দ। ওড়াকান্দিতে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও উলু ও শংখের ধ্বনিতে বরণ করে নেবে ক্ষমতাধর এ নেতাকে। এ সফরে দুই দেশের আন্তরিকতা বাড়বে বলে মনে করছে এলাকাবাসী।

এলাকার বাসিন্দা গোবিন্দ কির্ত্তনিয়া ও ছবি রানী বিশ্বাস বলেন, ঠাকুরবাড়ি বিশ্বের দলিত সম্প্রদায় মতুয়া ভক্তদের এক তীর্থভূমি। প্রতি বছর মতুয়া ভক্তরা পুণ্যলাভের আশায় এ তীর্থভূমিতে আসেন। নরেন্দ্র মোদি আসবেন, এতে আমরা অনেক আনন্দিত।

মোদির সফরকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে হেলিপ্যাড

ঠাকুরবাড়ির সদস্য অমিতাভ ঠাকুর বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী আমাদের ঠাকুরবাড়িতে আসছেন, এটি আমাদের জন্য খুশির এবং গর্বের বিষয়। আমরা তাকে স্বাগত জানানোর জন্য সকল প্রস্তুতি শুরু করেছি। তার আগমনে আমরা ধন্য হবো।

বাংলাদেশ মতুয়া মহাসংঘের মহাসংঘাতিপতি (সভাপতি) সীমা দেবী ঠাকুর বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী আমাদের ঠাকুরবাড়িতে আসছেন, এটা সকল মতুয়া ভক্তদের কাছে গর্বের বিষয়। মোদিকে বরণ করে নিতে নানা প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে ঠাকুরবাড়িতে। পুরুষের পাশাপাশি মহিলারাও উলু ও শংখের ধ্বনির মাধ্যমে বরণ করে নেবে বিশ্বের ক্ষমতাধর এ নেতাকে। তবে সরকারের অনুমতি মিললেই ধর্মীয় রীতিতে মোদিকে বরণ করা হবে।

ঠাকুরবাড়ির অপর সদস্য পদ্মনাভ ঠাকুর বলেন, নরেন্দ্র মোদি হেলিকাপ্টারযোগে ঠাকুরবাড়িতে আসবেন। পরে তিনি ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের সাথে কথা বলবেন। এরপর তিনি পাশের একটি মাঠে তিন শতাধিক নির্ধারিত মতুয়া নেতাদের সাথে মতবিনিময় করবেন। এর আগেও তিনি ওড়াকান্দি ঠাকুরবাড়িতে আসার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন, কিন্তু আসতে পারেননি।

কাশিয়ানী উপজেলা চেয়ারম্যান ও হরিচাঁদ ঠাকুরের ষষ্ঠ বংশধর সুব্রত ঠাকুর বলেন, ২৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওড়াকান্দির ঠাকুরবাড়িতে আসছেন। দেশ-বিদেশে হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের লাখ লাখ ভক্ত ও অনুসারি রয়েছেন। পুরো ঠাকুরবাড়ি গোয়েন্দা নজরদারিতে নেয়া হয়েছে। মোদিকে স্বাগত জানাতে সকল প্রস্তুতি শেষ হয়েছে।

মোদিকে স্বাগত জানাতে সকল প্রস্তুতি শেষ হয়েছে

টুঙ্গিপাড়া পৌরসভার মেয়র শেখ তোজাম্মেল হক টুটুল বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির সফরকে ঘিরে টুঙ্গিপাড়ায় সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সসহ পৌর এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন, শোভাবর্ধন করা হয়েছে।

টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদ মো. বাবুল শেখ বলেন, সরকারি কর্মসূচি পালনের জন্য টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা কাজ করছেন। মোদিকে বরণ করে নিতে নেতাকর্মীরা অধীর আগ্রহে রয়েছে।

গোপালগঞ্জ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী এহসানুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির সফরকে ঘিরে হেলিপ্যাড তৈরি, সড়ক সংস্কারসহ উন্নয়নমূলক কাজ শেষ হয়েছে। মোদিসহ কর্মকর্তাদের বহন করা হেলিকাপ্টার নামতে ঠাকুরবাড়ির পাশে তৈরি করা হয়েছে ৪টি হেলিপ্যাড। হেলিপ্যাড থেকে ঠাকুরবাড়ি যাওয়ার সড়কসহ লিংক রোড ও ঢাকা-খুলনা থেকে ঠাকুরবাড়ি যাওয়া-আসার সড়ক সংস্কার করা হয়েছে।

গোপালগঞ্জের পুলিশ সুপার আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, সফরকে কেন্দ্র করে পুরো টুঙ্গিপাড়া ও ঠাকুরবাড়ি নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে। প্রতিনিয়ত গোয়েন্দা নজরদারি করা হচ্ছে। সকলের সহযোগিতায় সুন্দর একটি অনুষ্ঠান উপহার দেয়ার আশা প্রকাশ করেন তিনি।

জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির সফর নির্বিঘ্ন করেত সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

ওড়াকান্দি কেনো তীর্থস্থান:

ধর্মীয় অনুশাসন ও আধ্যাত্মিক চিন্তা-চেতনা থেকে দেশ-বিদেশে ওড়াকান্দি হিন্দু দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে তীর্থভূমি। নিপীড়িত ও অবহেলিত নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের মুক্তির দূত আধ্যাত্মিক পুরুষ পূর্ণব্রহ্ম শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের কারণেই ওড়াকান্দি লাখ লাখ মতুয়াভক্তের তীর্থভূমিতে পরিণত হয়েছে। হরিচাঁদ ঠাকুর ও তার ছেলে গুরুচাঁদ ঠাকুরের ব্যাপক আধ্যাত্মিক শক্তি ছিলো বলে প্রচলিত আছে। এই আধ্যাত্মিক শক্তির বলে হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুর হিন্দু ধর্মালম্বীদের কাছে অবতার হিসেবে খ্যাত।

প্রচলিত আছে, হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের আধ্যাত্মিক শক্তির কারণে বিভিন্ন রোগাক্রান্ত মানুষ মুক্তি পেয়েছেন এবং অনেক বন্ধ্যা নারী সন্তান লাভ করেছেন। এছাড়া কুষ্ঠ রোগ ও বিপদ-আপদে পড়লে তাদের নাম স্মরণ করলে মুক্তি মিলতো বলে প্রচারিত আছে।

এভাবে হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের নামযশ দেশের সীমানা পেরিয়ে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে দেশ ও দেশের বাইরে তৈরি হয় অনেক অনুসারী। তখন থেকে তাদের ভক্ত ও অনুসারীরা ওড়াকান্দি এসে ঠাকুরকে মানত করতেন। প্রতি বছর হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মতিথিতে এখানে দেশ-বিদেশিসহ লাখ লাখ মতুয়াভক্ত আসেন। রোগমুক্তি ও কামনা-বাসনে পূরণের জন্য স্নান করেন। এর মাধ্যমে ঠাকুরের সন্তুষ্টি লাভের চেষ্টা করেন। এ সময় যার যার সাধ্যমতো ঠাকুরের নামে দান করেন।

কে এই হরিচাঁদ ঠাকুর:

শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর ১৮১১ সালের ১১ মার্চ কাশিয়ানী উপজেলা সাফলীডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মের পর থেকে সাফলীডাঙ্গা গ্রাম ধন্য হয়ে ওঠে। হরিচাঁদ ঠাকুরের বাল্য নাম ছিল হরি ঠাকুর। কিন্তু ভক্তরা তাকে হরিচাঁদ নামেই ডাকতেন। পিতা যশোবন্ত ঠাকুরের পাঁচ পুত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় পুত্র। পরে পার্শ্ববর্তী ওড়াকান্দি গ্রাম বসতি গড়েন হরিচাঁদ ঠাকুর। সেখানে হরিচাঁদ ঠাকুর অলৌকিকত্ব ও লীলার জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে।

হরিচাঁদ ঠাকুর

হরিচাঁদ ঠাকুর তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। পাঠশালা অতিক্রম করে তিনি কয়েক মাস মাত্র স্কুলে গিয়েছিলেন। পরে স্কুলের গণ্ডিবদ্ধ জীবন ভালো না লাগায় স্কুল ত্যাগ করে তিনি মিশে যান সাধারণ মানুষের সঙ্গে। প্রকৃতির আকর্ষণে তিনি রাখাল বালকদের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান। তার জীবদ্দশায় ওই এলাকার নিম্নবর্ণের হিন্দুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলেন। তখন নির্যাতিত হিন্দুদের পাশে দাঁড়ান এবং চৈতন্যদেবের প্রেম-ভক্তির কথা সহজ-সরলভাবে প্রচার করতেন।

১৮৭২ সালের ব্রিটিশ আদমশুমারিতে ৩৬টি বর্ণের উদ্ভব দেখানো হয়েছিল। তার আগে থেকেই সমাজে বর্ণপ্রথা ও অস্পৃশ্যতা প্রচলিত ছিল। তাই হরিচাঁদ ঠাকুর আদর্শ গার্হস্থ্য ধর্ম ও মতুয়াবাদ প্রচার করেছিলেন। এই মতুয়া মতবাদ প্রচার করতে গিয়ে তিনি নীল কুঠির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। সমাজে জমিদারি প্রথার বিরুদ্ধে লড়েছেন। জমিদারের লোকজন মতুয়া মতবাদ প্রচারে হরিচাঁদ ঠাকুরের অনুসারীদের বাধা দিয়ে বর্বর নির্যাতন করেছেন। তাদের বিপদ-আপদে সবসময় তিনি জাগ্রত থাকতেন। আর এভাবে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের কাছে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন।

হরিচাঁদ ঠাকুরের মতুয়াবাদ ও মতুয়ার অর্থ কি:

হরিচাঁদ নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে সাধনা করতে মতুয়াবাদ প্রচারের মাধ্যমে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সংগঠিত করেন। তার সাধন পদ্ধতিকে বলা হয় ‘মতুয়াবাদ’, আর এই আদর্শে যারা বিশ্বাসী, তাদের বলা হয় ‘মতুয়া’। মতুয়া শব্দের অর্থ মেতে থাকা বা মাতোয়ারা হওয়া। হরি নামে যিনি মেতে থাকেন বা মাতোয়ারা হন, তিনিই মতুয়া। মতান্তরে ধর্মে যার মত আছে, সেই মতুয়া।

  • সর্বশেষ
  • পঠিত