ঢাকা, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ আপডেট : ৩ ঘন্টা আগে
শিরোনাম

বেদখল ইলা মিত্রের বাড়ি

  এম. মাহফুজুর রহমান, ঝিনাইদহ

প্রকাশ : ১৯ নভেম্বর ২০১৭, ১১:৫৬  
আপডেট :
 ১৯ নভেম্বর ২০১৭, ১২:১৪

বেদখল ইলা মিত্রের বাড়ি

ঝিনাইদহের শৈলকুপা শহর থেকে পূর্ব-দক্ষিণ দিকে ১৩ কিলোমিটার দুরের গ্রাম বাগুটিয়া। গ্রামের একপ্রান্তে কাঁচা রাস্তার পাশে চুন-সুড়কি দিয়ে গাঁথা ৯ রুমের পুরনো একটি দ্বিতল বাড়ি। এলাকার অধিকাংশ মানুষই জানেনা বাড়িটির ইতিহাস। শুধু জানেন হিন্দু সম্প্রদায়ের কারো ছিল, এখন সেখানে হাজী কিয়াম উদ্দিনের ছেলেরা বসবাস করেন। তারা কীভাবে বাড়িটি ভোগদখল করছেন তা জানেন না এলাকাবাসী। গ্রামের গুটিকয়েক মানুষ কেবল জানেন যে, ‘বাড়িটি কোনো এক সংগ্রামী মানুষের।’

সেই সংগ্রামী মানুষটি হচ্ছেন তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী, সংগ্রামী নারী ইলা মিত্র। শৈলকুপা উপজেলার বাগুটিয়া গ্রামের এই বাড়িটি ইলা মিত্রের পৈত্রিক বাড়ি। ইতিহাসের স্বাক্ষী হয়ে এই বাড়িটি দাঁড়িয়ে থাকলেও রয়েছে বে-দখল। ভেঙে পড়তে শুরু করেছে ইটের গাঁথনিগুলো। চওড়া দেয়ালে ঘেরা প্রাচীরের অনেক অংশ ভেঙে ফেলেছে দখলদাররা। শুধু বাড়ি নয়, দখল করা হয়েছে ইলা মিত্রের বাবা নগেন্দ্রনাথ সেনের রেখে যাওয়া শত শত বিঘা জমি। সরকারের খাতায় এগুলো ভিপি তালিকাভুক্ত হলেও বাস্তবে তা এলাকার প্রভাবশালীদের দখলে।

ইলা মিত্র অবিভক্ত ভারতের কিংবদন্তী বিপ্লবী। বাবা নগেন্দ্রনাথ সেনের চাকরীর সুবাদে তাঁর জন্ম কলকাতায়। ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর তিনি জন্মগ্রহন করেন। তার বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন বেঙ্গলের ডেপুটি অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল। মা মনোরমা সেন গৃহিনী। ঝিনাইদহের বাগুটিয়া গ্রাম তাদের পৈত্রিক নিবাস। ইলা মিত্রের জন্ম কলকাতায় হলেও ছোট বেলায় তিনি বেশ কয়েকবার বাগুটিয়া গ্রামে এসেছেন। ১৯৪৫ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রামচন্দ্রপুরের জমিদার বাড়ির রমেন্দ্রনাথ মিত্রর সঙ্গে ইলা সেনের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তার নাম হয় ইলা মিত্র।

ইলা মিত্র তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুর দিকে অর্থাৎ ১৯৪৩ সাল থেকে তিনি ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত চাপাইনবাবগঞ্জের নাচোল অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।

১৯৪৬ সালে হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়িক দাঙ্গা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার সর্বত্র। ইলা মিত্র কমিউনিস্ট পার্টি থেকে নোয়াখালীর দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকায় সেবা ও পুনর্বাসনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ইলা মিত্র আত্মগোপন অবস্থায় ১৯৪৮-৪৯ সালে নাচোল কৃষকদের ফসলের দাবিতে ‘ তেভাগা আন্দোলন’ এর ডাক দেন এবং কৃষকদের ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়ান।

এই আন্দোলনের সময় তার উপর পুলিশের অমানবিক নির্যাতন চলে। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তিনি কারাগার থেকে প্যারোলে মুক্তি পেয়ে কলকাতায় চলে যান। এরপর তিনি কলকাতার বিভিন্ন রাজনৈতিক ও গনতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। তিনি কলকাতার মানিকতলা নির্বাচনী এলাকা থেকে পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৫৮ সালে তিনি কলকাতা সাউথ সিটি কলেজের বাংলা সাহিত্যে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। পাশাপাশি কলকাতার সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠনের কাজ করতে থাকেন।

মেধা ও নেতৃত্বের গুনে তিনি ধাপে ধাপে উপরে উঠতে থাকেন। বিধান সভায় ডেপুটি লিডার হন। ১৯৬২ সাল থেকে শিক্ষক প্রতিনিধি হিসাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট মেম্বার নির্বাচিত হন পাঁচবার।

সরেজমিনে ইলা মিত্রের পৈত্রিক বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুরনো আমলের নিদর্শন চুন-সুড়কির তৈরী দ্বিতল বাড়িতে বসবাস করছেন হাজি কিয়াম উদ্দিনের তিন সন্তান।

বড় ছেলে আলী হোসেন জানান, তারা বাগুটিয়রা ১১৬ নং মৌজার ২৩৪৫ দাগের জমির উপর বাড়িটি সহ ৮৪ বিঘা জমি ক্রয় করেছেন। বাবা হাজি কিয়াম উদ্দিন বহু পূর্বে ইলা মিত্রের বাবা নগেন্দ্রনাথ সেনের শ্বাশুড়ি সরোদিনি সেনের কাছ থেকে এই জমি কিনে নেন। সরোদিনি সেন কিভাবে এই জামির মালিক হলেন তা তিনি বলতে পারেন না বলে জানান। তিনি ছাড়াও তার ছোট ভাই জাহাঙ্গীর আলম, আব্দুর রশিদ ও রাশিদুল ইসলামের পরিবার এখানে বসবাস করেন। মূল ঘরটির ৫ টি রুম ব্যবহার করা যায়। ভাইয়েরা সেগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। বাকি রুমগুলো নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।

কিংবদন্তী নারী ইলার শৈশব কৈশর সময় পার করা বাগুটিয়া, গোপালপুর, শেখরা, রঘুনন্দপুর, শাহাবাজপুর সহ কয়েকটি গ্রামে। তার বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন, মা মনোরমা সেন এবং পিতামহ রাজমোহন সেনের নামে রয়েছে কয়েকশ বিঘা জমি। এসব ভিপি সম্পত্তি হিসাবে সরকারী খাতায় থাকলেও তার সবটুকুই এখন বে-দখল। তবে ভূমি অফিসের কর্মকর্তারা জানান এসব সম্পত্তির ব্যাপারে সেটেলমেন্ট অফিসে আপত্তি ও দুই শতাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে।

ইলা মিত্রের পরিবার সম্পর্কে ওই গ্রামের বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম জানান, তারা শুনেছেন নগেন্দ্রনাথ সেন নামে এক ব্যাক্তি তাদের এলাকার ছোট-খাটো জমিদার ছিলেন। বাগুটিয়াসহ পাশ্ববর্তী কয়েকটি মৌজায় বাবা নগেন্দ্রনাথ সেনের অঢেল জমি-জিয়ারত ছিল। যা বর্তমানে এলাকার প্রভাবশালীরা দখল করে নিয়েছে। হাজি কিয়াম উদ্দিন ছাড়াও জনৈক আমিনুল ইসলামের দখলে রয়েছে ওই নগেন্দ্রনাথ সেনের সিংহভাগ জমি। তবে তিনি যে ইলা মিত্রের বাবা ছিলেন এটা তারা জানতেন না। তার দাবি, বাড়িটি যদি ইলা মিত্রের হয় তাহলে এটি সংরক্ষণ করা জরুরী। তার মতে, এটা রক্ষা হলে এক কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস রক্ষা হবে।

বাগুটিয়া গ্রামের কৃষক বিশারত আলী জানান, ইলা মিত্রের পৈত্রিক বাড়ী ও সম্পদ রক্ষণাবেক্ষন করা উচিৎ।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্রী সুলতানা জামান বলেন, নতুন প্রজন্মের মানুষের কাছে ইলা মিত্রের এই অঞ্চলের ইতিহাস তুলে ধরা উচিৎ এর জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

কমিউনিস্ট পার্টি অব বাংলাদেশ এর ঝিনাইদহ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক স্বপন বাগচী জানান, নির্যাতন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে আসা নারী নেত্রী ইলা মিত্রের শৈলকুপার পৈত্রিক সম্পদ সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষন ও বাড়ী দর্শনীয় করে তোলা উচিৎ।

২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর ৭৭ বছর বয়সে এই মহিয়সী নারী কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

/এসএস/

  • সর্বশেষ
  • পঠিত