দফায় দফায় বন্যার ধাক্কায় বেসামাল উত্তরাঞ্চল
প্রতিনিধি, বাংলাদেশ জার্নাল
প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২০, ২০:২৩
ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, তিস্তা ও যমুনা, আত্রাই ও করতোয়াসহ সবকটি নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। বন্যায় প্রতিনিয়ত প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন অঞ্চল। ভেঙে যাচ্ছে কাচা-পাকা সড়ক। তলিয়ে যাচ্ছে আমনসহ সবজির ক্ষেত। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ছে।
গাইবান্ধা, রাজশাহী, শিরাজগঞ্জ ও নাটোর থেকে পাঠানো বাংলাদেশ জার্নালের প্রতিনিধিদের প্রতিবেদনে বন্যার রূপ ফুটে উঠেছে। এদিকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি ত্রাণ পর্যাপ্ত মজুদ আছে। কিন্তু বন্যাকবলিত মানুষজন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, পর্যাপ্ত ত্রাণের অভাব রয়েছে।
গাইবান্ধা: করতোয়া নদীর পানি কাটাখালি পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩ সেন্টিমিটার বেড়ে ১১৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি গত ২৪ ঘণ্টায় ৪ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ঘাঘট নদীর পানি ২৪ ঘণ্টায় ৫ সেন্টিমিটার বেড়ে গাইবান্ধা শহরের নতুন ব্রিজ পয়েন্টে বিপদসীমার ২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তার পানি বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। আর তিস্তা, বাঙ্গালী ও যমুনা নদীর পানি হু হু করে বাড়ছে।
পানি বৃদ্ধির বিষয়টি শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোখলেছুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
চলতি বছর পরপর ৪ দফা বন্যার ধকল কাটাতে না কাটাতে ৫ম দফা বন্যায় লক্ষাধিক মানুষ ফের পানিবান্দি হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা। পানি বৃদ্ধির ফলে গোবিন্দগঞ্জ-ঘোড়াঘাট-দিনাজপুর আঞ্চলিক মহাসড়ক তলিয়ে গেছে। পৌরসভার হাজার হাজার মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভার বাসিন্দা কলিম উদ্দিন জানান, আমরা অনেক কষ্টে আছি। গত ২০ বছরে করতোয়া নদীতে এতো স্রোত দেখিনি। তীব্র স্রোতে নদীর আশেপাশে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
পলাশবাড়ী উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের মাহমুদ আলী জানান, বন্যার পানিতে বসতবাড়ীতলে গেছে। অনেক কষ্টে উঁচু স্থানে মানবেতন জীবন কাটাচ্ছি। কেউ আসে না খোঁজ নিতে।
পলাশবাড়ী উপজেলার তেনাকী গ্রামের কাশেম উদ্দিন জানান, বাঁধ ভেঙে গত সপ্তাহে এই উপজেলার ১৫টি গ্রাম পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এই উপজেলায় আমন ধানের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। পানিবন্দি হাজার হাজার পরিবারের সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন।
গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভার বাসিন্দা আব্দুল মালেক জানান, বন্যার কারণে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সঙ্গে ঘোড়াঘাট উপজেলা হয়ে দিনাজপুর জেলায় যোগাযোগের আঞ্চলিক মহাসড়কটি বন্যার পানির নিচে ডুবে গেছে। এতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে।
পালাশবাড়ী উপজেলার কিশোরগাড়ী ইউনিয়নের বাসিন্দা কাদের আলী বলেন, বন্যার পানি বেড়ে যাওয়ায় আমাদের কষ্ট বেড়েছে। আমরা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছি।
সাঘাটা উপজেলার হেলেঞ্চা গ্রামের চান্দু মিয়া বলেন, এবারের বন্যায় আমার পাঁচ বিঘা জমির ফসল পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এখন আমি নিঃস্ব। সামনের দিনে কি খাবো নিজেও জানি না।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার হরিতলা গ্রামের আব্দুল মালেক জানান, উপজেলার বগুলাগাড়ীতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে প্রায় পাঁচটি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে আমন ধান, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ফসল।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফজানান, বন্যায় এ উপজেলায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বন্যা কবলিত ও ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে আমরা ত্রাণ বিতরণ করছি। সরকারিভাবে আরো ত্রাণের প্রয়োজন।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা একেএম ইদ্রিস আলী বলেন, পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী মজুত আছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে। বন্যায় কবলিত ও ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে ত্রাণ বিতরণ অব্যহত আছে।
রাজশাহী: বন্যার কবলে পড়েছে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার ১৬টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌর এলাকার প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। দিন দিন বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা।
পানিবন্দি থেকে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও নিরাপদ আশ্রয়ের অভাবে সীমাহীন দুর্ভোগে আছেন এসব অঞ্চলের দিনমজুর-ক্ষেতমজুরসহ খেটে খাওয়া মানুষ। পর্যাপ্ত ত্রাণ না মেলায় অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটছে তাদের। অভাব দেখা দিয়েছে গোখাদ্যের।
বন্যায় ফসল ও বাড়িঘর, রাস্তা-ঘাটের ক্ষতি হয়েছে। গ্রামে গ্রামে বাড়ি-ঘর তলিয়ে মানুষ গৃহবন্দি রয়েছে। ভেঙে পড়েছে মাটির ঘর-বাড়ি। বসতবাড়িতে পানি ওঠায় মানুষ বাঁধ ও সড়কের উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। শত শত হেক্টর পাকা ধান, পাট ও সবজি ক্ষেত ভেসে গেছে। ভেসে গেছে শত শত পুকুরের মাছ। গৃহপাালিত পশু নিয়েও বিপাকে পড়েছেন তারা।
রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গত এক সপ্তাহের টানা বর্ষণের সঙ্গে উজানের পানির তোড়ে বন্যা দেখা দিয়েছে।
সিরাজগঞ্জ: এদিকে কয়েকদিন ধরে সিরাজগঞ্জ ও কাজীপুর পয়েন্টে যমুনার পানি বেড়েই চলেছে। যমুনা নদীর পানি বর্তমানে সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ১০ সেন্টিমিটার ও কাজিপুর পয়েন্টে বিপদসীমার ১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দ্রুত বেড়ে চলা যমুনার পানি দেখে তীরবর্তী চরাঞ্চলের মানুষজন আবারও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। নদীর আশেপাশে ভাঙনের ভয় দানা বাধছে তাদের মনে।
সিরাজগঞ্জের ৫টি উপজেলার নিম্নাঞ্চল বন্যা কবলিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে এখন হাজার হাজার মানুষ। বহু পরিবার স্থানীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ বিভিন্ন উচু স্থানে আশ্রয় নিচ্ছেন। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (হেড কোয়ার্টার) রফিকুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
কয়েকদিন ধরে পাহাড়ি ঢল ও দফায় দফায় প্রবল বর্ষণে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে এখন বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ইতোমধ্যেই যমুনা তীরবর্তী শাহজাদপুর, চৌহালী, বেলকুচি, কাজিপুর ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার অধিকাংশ নিম্নাঞ্চল বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে।
এসব অঞ্চলের অনেক কাঁচাপাকা রাস্তাঘাট যোগাযোগে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে এবং তলিয়ে গেছে রোপা আমনসহ বিভিন্ন ফসল। বিশেষ করে চৌহালী, শাহজাদপুর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে। ১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ দফা বন্যায় রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সেইসাথে হাজার হাজার পরিবার বন্যা ও ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক পরিবার এখনও মানবেতর জীবনযাপন করছে।
এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এবিএম রওশন কবীর বলেন, যমুনা তীরবর্তী পাঁচটি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে এবং ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
নাটোর: নাটোরের বন্যা পরিস্থিতিও চরম অবনতি হচ্ছে। বিপাকে পড়েছে জেলার দুই উপজেলার কয়েক লাখ মানুষ। বন্যায় ডুবে গেছে প্রায় ৩ হাজার হেক্টর জমির ফসল। তলিয়ে গেছে শত শত পুকুর। ভেসে গেছে কোটি টাকার মাছ।
বৃহস্পতিবার সিংড়া পয়েন্টে আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমার ১১১ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে দেখা গেছে। নদীর পানির চাপে সড়ক ভেঙে পানি ঢুকছে জনবসতি এলাকায়। পৌর এলাকার শোলাকুড়া এলাকার সড়ক ভেঙে গেছে। এতে সিংড়ার সাথে কলম, বিলদহর ও কালীগঞ্জের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। সিংড়া পৌর এলাকার ১২টি ওয়ার্ডেই পানি প্রবেশ করেছে। ভারী বর্ষণ আর উজানের ঢলে আত্রাই নদীর পানি আবারো বেড়ে গেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, আত্রাই নদীতে বিভিন্ন স্থানে অবৈধভাবে পেতে রাখা সুতি জালের কারণে পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে পানি উপচে পড়ে নদীর দু’ধারে চাপ সৃষ্টি করছে। এতে একদিকে চলনবিলের বাঁধগুলো ভেঙে যাচ্ছে, অপরদিকে গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অসংখ্য মানুষ।
প্রশাসন বারবার অভিযান চালিয়ে এসব সুতি জাল অপসারণ করলেও, তারা আবারও জাল দিয়ে মাছ শিকার করছেন। এসব কারণে পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হওয়ায় ভুগছেন সাধারণ মানুষ। তাদের অভিযোগ, অল্প সংখ্যক মানুষের জন্য এলাকার কয়েক লাখ মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন বলে জানান।
বাংলাদেশ জার্নাল/এসকে